ষ্টাফ রিপোর্টার\ নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চক-চান্দিরা গ্রাম। এ গ্রামে প্রায় আট কিলোমিটার বিস্তৃত পাশাপাশি ছোট-বড় ৩৬৫টি পুকুর রয়েছে। এসব পুকুর দেখতে প্রতিদিনই ওই গ্রামে আসছেন দর্শনার্থীরা।
রাস্তাঘাটের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে এলাকার শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থসামাজিকের উন্নয়ন হবে বলে মনে করছেন তারা।
জেলা শহর থেকে উত্তরে ধামইরহাট উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। আর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে ১৬ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতি ঘেরা ছায়া সুনিবিড় ঘুকশি নদীর তীরে গ্রাম চক-চান্দিরা। তবে জেলা শহর থেকে বদলগাছী উপজেলা হয়ে উত্তরে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে গ্রামটি। গ্রামে প্রবেশ পথে দেখা যাবে মাটির রাস্তার দু’ধারে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, মাটির ও আধাপাকা বসতবাড়ি। এ গ্রামে বাড়ি রয়েছে ৩৫০টি আর ছোট-বড় পুকুর রয়েছে ৩৬৫টি। পুকুরগুলো পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। আবার কিছু পুকুর চার কোণাকৃতি। পুকুরপাড়ে বন বিভাগের রয়েছে সবুজ বনায়নও।
লোককথা, অষ্টম শতাব্দীর পাল বংশের রাজা চান্দিলাল পালের তার স্ত্রীর প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। হঠাৎ স্ত্রী কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর রোগ আরোগ্য লাভে রাজ দরবারে হেকিম, কবিরাজ ও বৈদ্যের নিয়ে রাজ দরবারে সভা হয়। হেকিমরা রাজাকে স্ত্রীর রোগ থেকে মুক্তি লাভে ৩৬৫টি পুকুর খনন করার পরামর্শ দেন। রানী প্রতিদিন আলাদা পুকুরে স্নান করবেন। এতে রানীর রোগ থেকে মুক্তি মিলবে। হেকিমদের পরামর্শে রাজা পুকুরগুলো খনন করেন। আর প্রতিটি পুকুরে তিন-চারটি সান বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়।
কেউ কেউ জানান, রাজা তার দুই স্ত্রীর জন্য আলাদা আলাদা পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীতে তা দুই সতীনের পুকুর নামে পরিচিত ছিল। আবার পুকুরে পাথর একা একা চলাফেরা করত বলে পুকুরের নাম করণ করা হয়েছিলো পাথর পকড়া। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই রাজা, রাজ্য আর রাজপ্রসাদ। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে আজও রয়েছে পুকুরগুলো। মানুষের মুখে মুখে আজও রয়ে গেছে সেই লোককথা।
স্থানীয় যুবক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ পুকুর দেখার জন্য আসছেন। গ্রামের রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন করা দরকার। গ্রামটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হলে শিক্ষিত বেকার যারা আছি তাদের কর্মসংস্থান হতো। এছাড়া এলাকার অনেক উন্নয়ন হতো।’
বয়োজ্যেষ্ঠ ইব্রাহিম হোসেন ও নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে আমরা এ গ্রামে বসবাস করছি। এর আগে আমরা ভারতে বসবাস করতাম। এখানে আসার পর গাছ ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। আর পুকুরগুলোও ঘাসে পরিপূর্ণ ছিল। প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পুকুরের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রতিটি পুকুরে তিন-চারটি ¯œান বাঁধানো ঘাট থাকলেও এখন তা নেই। এছাড়া ইট এবং পাথরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একটি পাথর পুকুরে ভাসতো। ওই পাথরটি পুকুর পাড়ে রেখে দিলে পরদিন আবারও ভাসতে দেখা যায়। কিন্তু এখন ওই পাথরটি চলাচল না করায় মনে হচ্ছে মারা গেছে। পুকুরগুলো সরকার থেকে ইজারা নিয়ে অনেকেই মাছ চাষ করছেন।’
স্থানীয় ইসবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল আলম লাকী বলেন, ইতিহাসের কোথাও একই গ্রামে এতগুলো পুকুর আছে কি না আমার জানা নেই। চক-চান্দিরা গ্রামটি অবহেলিত। গ্রামটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বপ্রথম রাস্তা পাকাকরণ জরুরি। এছাড়া পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। পুকুরকে কেন্দ্র করে গ্রামটি পর্যটন এলাকা হলে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
চক-চান্দিরা গ্রাম প্রাচীন জনপদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ও ধামইরহাট এমএম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইতিহাস থেকে জানা যায়- ঘুকশি নদী এক সময় প্রবল প্রমত্তা নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। এ নদীটি আত্রাই নদীর আদি খাঁ। যা ছোট যমুনা নদীর নিম্নভাগ এবং দেিণ ত্রিমোহনীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চক-চান্দিরা গ্রাম। এ গ্রামটি প্রাচীন সভ্যতায় উন্নত সমৃদ্ধ একটা নগরী। যেখানে প্রাচীন দালান কোঠা, রাস্তা-ঘাট ও জনপদ ছিল বলে ধারণা করা হয়। ওই গ্রামে যেসব পুকুর খনন করা হয়েছিল বর্তমানে তার ৩৬৫টি পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, কোন রাজার আমলে এবং কখন পুকুরগুলো খনন করা হয় তার সঠিক ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ নাই বা পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা যায় পাল যুগের পূর্বে অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু শাসনামলে ওই এলাকায় একটি রাজবাড়ির অস্তিত্ব ছিল। সেই রাজবাড়ির রাজা বা অন্য কোন রাজার ইতিহাস লোকমুখে বা বংশপরম্পরায় আমরা শুনে আসছি।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো. খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, ধামইরহাট উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অনেকগুলো পুকুর রয়েছে। ওই এলাকায় অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ। সেখানে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকাটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এবং আকর্ষণীয় করতে এরই মধ্যে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক:
শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া
সহযোগী সম্পাদক: তোফায়েল আহমেদ
অফিস: সম্পাদক কর্তৃক আজমিরী প্রেস, নিউমার্কেট চান্দিনা প্লাজা, কুমিল্লা থেকে মুদ্রিত ও ১৩০৭, ব্যাংক রোড, লাকসাম, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত। ফোন: ০২৩৩৪৪০৭৩৮১, মোবাইল: ০১৭১৫-৬৮১১৪৮, সম্পাদক, সরাসরি: ০১৭১২-২১৬২০২, Email: laksambarta@live.com, s.bhouian@live.com