\ জান্নাতুল ফেরদাউস পুষ্প \
আরাল সাগর একটি এন্ডোরহেইক হ্রদ- যার উত্তরে কাজাখস্তান এবং এর দক্ষিণে উজবেকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত যা ১৯৬০-এর দশকে সংকুচিত হতে শুরু করে এবং ২০১০-এর দশকে প্রধানত শুকিয়ে যায়। এটি কাজাখস্তানের আকতোবে এবং কিজিলোর্দা অঞ্চলে এবং উজবেকিস্তানের কারাকালপাকস্তান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ছিল। নামটি মোটামুটিভাবে মঙ্গোলিক এবং তুর্কি ভাষা থেকে অনুবাদ করে “দ্বীপের সাগর”, যা একসময় এর জলে বিন্দু বিন্দু বিস্তৃত বিপুল সংখ্যক দ্বীপের (১১০০ শ’টিরও বেশি) উল্লেখ ছিল। আরাল সাগরের নিষ্কাশন অববাহিকা উজবেকিস্তান এবং আফগানিস্তান, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের কিছু অংশকে ঘিরে রেখেছে।
হিন্দুস্তান টাইমস্ জানিয়েছে যে, কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত আরাল সাগর মাত্র ৫০ বছরেই শুকিয়ে গিয়েছে। এটি বর্তমানে (উরংধঢ়ঢ়বধৎবফ) বিরাট চমক!
বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার প্রভাব ধ্বংসের মুখে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বকে। চলতি বছরেই, প্রথমবারের মতো বিশ্ব গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির উপরে চলে গিয়েছে। যাই হোক, এর এক দশকেরও বেশি আগে, পৃথিবী একটি সম্পূর্ণ সাগরকে অদৃশ্য হতে দেখেছিল। এর নাম ছিল আরাল সাগর। কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যে অবস্থিত এই সাগর ২০১০ সালের মধ্যে শুকিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই শুকিয়ে যাচ্ছিল সাগরের জল। সোভিয়েত সেচ প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে আরাল সাগরের জল। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই আরাল সাগরের শুকিয়ে যাওয়া, কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। পরিবেশ ধ্বংসের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এটি। এই সাগরে একসময় গড়ে উঠেছিল জনজীবন। ৬৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার (ঈধঃপযসবহঃ ধৎবধ ১,৫৪৯,০০০ শস২ (৫৯৮,১০০ ংয় সর)
বিস্তৃত আরাল সাগর এখন সম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর চোখের আড়ালেই চলে গিয়েছে। শুধুমাত্র একটি নির্জন ল্যান্ডস্কেপ রেখে গিয়েছে এটি।
কেন শুকিয়ে গেল আরাল সাগরের জল; নাসার আর্থ অবজারভেটরি আরাল সাগরের অদৃশ্য হওয়ার কারণ সম্পর্কে একটি বিশদ বিশ্লেষণ পোস্ট করেছে। ১৯৬০-এর দশকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সেচের উদ্দেশ্যে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের শুষ্ক মরুভূমিতে একটি বড় জল পরিবর্তন প্রকল্প শুরু করে। মূলত: শুষ্ক অঞ্চলে তুলোসহ অন্যান্য ফসল চাষের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক এই বৃহৎ জল বিমুখ পরিকল্পনাই আরালের জল শুকিয়ে যাওয়ার আসল কারণ বলে দাবি করেছে নাসার আর্থ অবজারভেটরি।
এনসাইকোপিডিয়া ব্রিটানিকা জানিয়েছে যে, আরাল সাগরটি নিওজিন যুগের শেষে (২৩ থেকে ২৬ মিলিয়ন বছর আগে) গঠিত হয়েছিল- যখন দু’টি নদী অর্থাৎ উত্তরে সির দরিয়া এবং দক্ষিণে আমু দরিয়া, তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণ হ্রদ আরাল সাগরের উচ্চ জলস্তর বজায় রেখেছিল। এরপর চাষাবাদের জন্য এই দু’টি নদী থেকেই জল সেচ করতে গিয়ে জলের অভাবে শুকিয়ে যায় আরাল সাগর।
আরাল সাগর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ২৭০ মাইল (৪৩৫ কিমি) এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ১৮০ মাইল (২৯০ কিমি) এরও বেশি বিস্তৃত ছিল। কিন্তু খামার তৈরির জন্য নদীর জল সরিয়ে নেওয়ার পর সাগরের জল কমে যায় এবং সমগ্র সাগর বাষ্পীভূত হয়ে যায়। যদিও এর হ্রদের কিছু অংশ বাঁচানোর প্রচেষ্টায় কাজাখস্তান আরাল সাগরের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যে একটি বাঁধ তৈরি করেছে। কিন্তু এখন জলের উৎসকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। আরাল সাগরের অববাহিকার দেশ হলো: আফগানিস্তান; ইরান; কাজাখস্তান; কিরগিজস্তান; রাশিয়া; তাজিকিস্তান; তুর্কমেনিস্তান; উজবেকিস্তান।
মূলত: আরাল-এর নামের সঙ্গে সাগর শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি মূলত হ্রদ ছিল। তবে বিশালতার কারণে আরবদের কাছে এই হ্রদটি পরিচিত ছিল সাগর হিসেবে। ভূগোলের পরিভাষায় আরাল এখনও সাগর। তবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সাগর। এখন আরাল সাগর মাত্র ছোট জলাশয়ে রূপ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের দিকে আরাল সাগর পৃথিবীর বুকে চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে আরাল সাগরের বয়স প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বছর। এই সাগরের জলরাশি কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত ছিল। উত্তর থেকে সির দরিয়া ও দক্ষিণ থেকে আমু দরিয়া নদী থেকে পানি এসে মিশত আরালের বুকে। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৬৭ হাজার বর্গ কিমি আয়তনের হ্রদটির প্রায় ৭০ শতাংশ শুকিয়ে গেছে। আর এই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরাল সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্তমান পৃথিবীর জন্য এক অশনিবার্তা। এই সাগর শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলা চাষকে। সোভিয়েত তখন আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী। ক্রেমলিন বনাম হোয়াইট হাউসের হিমশীতল লড়াই চলছে। বিশ্ববাজারে তুলা উৎপাদনের শিরোপা ধরে রাখতে মরিয়া সোভিয়েত। এ কারণে তুলা চাষের ওপর বড়সড়ো নজর দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমান কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান সে সময়ে সোভিয়েতের অধীন ছিল। সোভিয়েত সরকারের আদেশেই শুরু হয় তুলার চাষ। সোভিয়েত সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, আমু এবং সির দরিয়ার পানি তুলােেত সেচের জন্য ব্যবহার করা হবে। অন্যদিকে, ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কারাকুম খাল খনন করে। যার দৈর্ঘ ছিল ১৩৭৫ কিলোমিটার। আর আজ পর্যন্ত এটিই পৃথিবীর দীর্ঘতম সেচ খাল। এ খাল দিয়েই আমু ও সির দরিয়ার পানি কারাকুম মরুভূমির ভেতর দিয়ে তুলােেত প্রবাহিত করা হতো। এই দীর্ঘ পথে ৩০ শতাংশ পানি অপচয় হতো। এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন বাঁধ ও খাল খনন করা হয় সে সময়। যার মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় হ্রদের পানিতে লবণের পরিমাণ বাড়তে থাকে, যার ফলে হ্রদের মাছ সব মরে যায়। সেই সঙ্গে কৃষি কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। আরাল সাগরের ধ্বংসের শুরুটা এখানেই। ওদিকে, আরাল সাগরের মাছ ধরে অনেক অধিবাসী জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু, ১৯৬০-৭০-এর দিকে বিশাল হ্রদের পানি দ্রæত শুকিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৯৮০ সালে আমু দরিয়া নদীতে বাঁধ দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে হ্রদের পানি শুকিয়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে ৯০ শতাংশ পানি শুকিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হ্রদের পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। এ ছাড়াও বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্পকারখানার বর্জ্য আরাল সাগরের পানিতে নিষ্কাশন করা হতো। পরবর্তী সময়ে আরালের অধিবাসীরা উপায় না দেখে অন্য প্রদেশে চলে যেতে থাকেন।
বলা বাহুল্য, সোভিয়েত বিলুপ্ত হয় নব্বই দশকে। এর মধ্যে আরল সাগর তীরের কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান দু’টি স্বাধীন দেশ তৈরি হয়। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে করা জরিপ অনুযায়ী, আরাল সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি শুকিয়ে গেছে। অর্থাৎ, এক সময়ের বিশাল আরাল সাগর সামান্য জলাশয়ে পরিণত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আরল সাগর বাঁচাতে একজোট হয় কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান। ২০০৩ সালে কাজাখস্তান সরকার বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানি আরাল সাগরের দিকে প্রবাহিত করার উদ্যোগ নেয়। ২০০৫ সালে বাঁধ নির্মাণের পর কাজাখ অঞ্চলের দিকে পড়া আরল সাগরের অংশে পানির স্তর বাড়ে। এরপর উজবেকিস্তানের অংশে বাঁধ দিয়ে আরল সাগরের পানির স্তর বাড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। উজবেকিস্তানের দিকে এই প্রকল্প তেমন সফল হয়নি। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংক এ কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাজাখ সরকারকে ৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করা ছাড়াও প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্বব্যাংক। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় উত্তর আরাল সাগরে পানিপ্রবাহ শুরু হয়। এ ছাড়াও এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, ইউনাইটেড আরাব আমিরাত। পুনরায় আরাল সাগরে মৎস্যশিল্প গড়ে উঠে। এর পর, ২০১৪ সালে নাসা প্রকাশিত উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, এর পূর্বাঞ্চলীয় দিকটি পুরোটা শুকিয়ে গেছে। এই অঞ্চলটি এখন কারাকুম মরুভূমি নামে পরিচিত। আরল সাগর বিপর্যয়কে গত শতাব্দীর মানুষ সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। একসময় খুব সহজেই এ সাগর থেকে একশ কেজি মাছও ধরে ফেলা যেতো। লেকের তীরে তরমুজ, গমের চাষও হতো আগে। তবে এখন তা মরুভূমি। অদূর ভবিষ্যতে আরাল সাগর আবার তার হারানো জীবন-যৌবন ফিরে পেতে পারে- এখনও এই আশাতেই বিভোর হয়ে আছেন স্থানীয় জেলেরা।
সম্পাদক ও প্রকাশক:
শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া
সহযোগী সম্পাদক: তোফায়েল আহমেদ
অফিস: সম্পাদক কর্তৃক আজমিরী প্রেস, নিউমার্কেট চান্দিনা প্লাজা, কুমিল্লা থেকে মুদ্রিত ও ১৩০৭, ব্যাংক রোড, লাকসাম, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত। ফোন: ০২৩৩৪৪০৭৩৮১, মোবাইল: ০১৭১৫-৬৮১১৪৮, সম্পাদক, সরাসরি: ০১৭১২-২১৬২০২, Email: laksambarta@live.com, s.bhouian@live.com