আবুল কাশেম গাফুরী\ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কাঁকড়ি নদীর দু’পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। এই স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বসতবাড়ী, মার্কেট ও দোকান ঘর। কাঁকড়ির পাড় নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। হাত বদল করলেই দখলকারিরা পাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। উচ্ছেদের একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তা আবার থমকে দাড়ায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কাঁকড়ি বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমা নদী। নদীটি ভারতের ত্রিপুরার পূর্বাংশের সিপাহীজেলা হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর ইউনিয়ন দিয়ে প্রবেশ করে নাঙ্গলকোট উপজেলার ডাকাতিয়া নদীতে এসে মিলিত হয়।
নদীটির দৈর্ঘ্য ১৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্ত ২২ মিটার এবং এটি সর্পিলাকার প্রকৃতির নদী। আর এই কাঁকড়ি নদীটি উজিরপুর থেকে কাশিনগর ইউনিয়ন হয়ে ডাকাতিয়া নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই নদী ওই অঞ্চলে বর্ষার মৌসুমে পানি নিস্কাষনের অন্যতম মাধ্যম। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি দিয়ে চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট ও সদর দক্ষিণ উপজেলার কৃষকরা ফসলী জমিতে সেচ দিতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রভাবশালী মহল নদীর দু’পাড় দখল করে গড়ে তুলেছে কয়েক শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। রয়েছে বসতবাড়ী, গড়ে উঠেছে মার্কেট ও দোকানঘর।
এক সময়ের প্রবাহমান কাঁকড়ি নদীটি বর্তমানে প্রায় মৃত। ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীটির গড় প্রস্থ ২২ মিটারের মধ্যে রয়েছে ৯ থেকে ১০ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড একাধিকবার নদীটি খনন করলেও তা কোন কাজে আসছে না। অবৈধ দখলদারদের কারনে নদীটি হারিয়েছে তার নাব্যতা। যার কারনে বর্ষা মৌসুম আসলে পানি নিস্কাষন না হওয়ার কারনে প্লাবিত হয় ৩ ইউনিয়নের জনপদ।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, নদীটির মিয়া বাজার, কলা বাগান ও কাশিনগরের বিশাল এলাকা জুড়ে প্রভাবশালী মহল দু’পাড় দখল করে নদীর জায়গা ক্রয়-বিক্রয় করে যাচ্ছেন। এক হাত বদল হলে জায়গা প্রতি মিলে কয়েক কোটি টাকা। নদীটির কাশিনগরের বিশাল অংশে গড়ে উঠেছে শতাধিক মার্কেট ও দোকান ঘর। কয়েকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারনে তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
কুমিলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কাঁকড়ি নদীর কাশিনগর এলাকায় ২০২০ সালে ৬৮টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ গ্রহণ করে কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০২০ সালের ১৯শে ফেব্রæয়ারি উচ্ছেদ অভিযানের তারিখ নির্ধারন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালিন কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল লতিফ এবং তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোঃ আবুল ফজর মীর। উচ্ছেদ কার্যক্রমের জন্য কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রিটও নিযুক্ত করা হয়। উচ্ছেদ অভিযানের আগের দিন তৎকালিন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের হস্তক্ষেপে উচ্ছেদ অভিযানটি বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিনে কাশিনগর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর ২ পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকান ঘর ও বহুতল ভবন। পাড়ের জায়গা দখলকারীরা হাত বদল করে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাশিনগর এলাকার জুলফে আলী মেম্বার তার দখলকৃত জায়গাটি বিক্রি করেন জাকির হোসেন নামক এক ব্যক্তির কাছে। একই কায়দায় আবুল কাশেম, মনিরুজ্জামান দখল সত্তে¡ বিক্রি করেছেন তৃতীয় একটি পক্ষের কাছে। এ ছাড়াও ফয়েজ আহাম্মেদ ও মোঃ হারুন বিক্রি করে দিয়েছেন জসিম ও সুলতান নামের ব্যক্তির কাছে। অহিদ মিয়া বিক্রি করে দিয়েছেন নুর হোসেন ও আবুল মিয়ার কাছে। নুরুল আমিন ও বিক্রি করে দিয়েছেন তার দখলকৃত জায়গাটি। সাবেক ইউপি মেম্বার সামছু উদ্দিন বিক্রি করে দিয়েছেন মোঃ কালাম, আবুল বাশার ও সুরুজ মিয়ার নিকট। এই সকল ব্যক্তিরা কাঁকড়ি নদী দখল সূত্রে বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর এই জায়গাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকান ঘর ও বহুতল মার্কেট।
আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি বলেন, কাশিনগর বাজারে কাঁকড়ি নদীর পাড়ে তাদের একটি তেলের মিল ছিলো। বিগত ২০২১ সালে সাবেক সংসদ মজিবুল হকের সহযোগিতায় তার প্রতিষ্ঠানটি রাতের আধাঁরে দখল করে নেয় সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এর বিনিময়ে মজিবুল হক সাইফুল ইসলাম থেকে ৫ কোটি টাকা আদায় করে নেয়। আমি প্রতিবাদ করলে মজিবুল হক আমাকে বেশ কয়েকটি হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেন। আর এই সুযোগে রাতের আধারে আমার প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে তারা দখল করে নেয়। আবুল বাশার আরো বলেন, আমি আমার তৎকালিন দোকানের পাশে আব্দুস সালাম থেকে ১০ শতক জায়গা ২ কোটি টাকা দিয়ে দখল সূত্রে ক্রয় করি। আমার সেই জায়গাটিও তারা দখল করে নেয়।
সাবেক ইউপি সদস্য সামছুল আলম বলেন, কাশিনগর এলাকায় কাকড়ি নদীর কয়েক একর জায়গা রয়েছে। জায়গাগুলো যে যার মতো দখল করে মার্কেট ও দোকান ঘর তৈরি করেছে। দখল সত্ত¡ হিসাবে অনেকে আবার অন্যের কাছে কোটি টাকা মূলে বিক্রি করছে।
“আপনিও তো নদীর জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন” এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি আমার দখল সত্তে¡র জায়গাটি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। আমার মতো অনেকে এইভাবে ক্রয় বিক্রয় করে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ অলিউজ্জামান বলেন, উচ্ছেদ অভিযান একটি নিয়মিত কার্যক্রম। আমরা পর্যায়ক্রমে জেলার সকল নদীর অবৈধ দখল স্থাপনা উচ্ছেদ করবো। কাঁকড়ি নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য মন্ত্রনালয়ে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করবো।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়ছার বলেন, কাঁকড়ি নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয় আমি অবগত নই। খোজখবর নিয়ে কাকড়ি নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সম্পাদক ও প্রকাশক:
শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া
সহযোগী সম্পাদক: তোফায়েল আহমেদ
অফিস: সম্পাদক কর্তৃক আজমিরী প্রেস, নিউমার্কেট চান্দিনা প্লাজা, কুমিল্লা থেকে মুদ্রিত ও ১৩০৭, ব্যাংক রোড, লাকসাম, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত। ফোন: ০২৩৩৪৪০৭৩৮১, মোবাইল: ০১৭১৫-৬৮১১৪৮, সম্পাদক, সরাসরি: ০১৭১২-২১৬২০২, Email: laksambarta@live.com, s.bhouian@live.com