ষ্টাফ রিপোর্টার\ মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অবসান ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। অবিস্মরণীয় এই বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জাতীয় জীবনে সূচিত হয় নতুন অধ্যায়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও অগণিত মুক্তিকামী মানুষের অপরিসীম ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই যুদ্ধ ও বিজয় জাতীয় অগ্রগতির অভিযাত্রায় অন্তহীন প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় অনাগতকাল অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা যাদের রক্ত ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, আজকের দিনে সেই মুক্তিসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আমরা বিন¤্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। সঙ্গত বিবেচনাতেই আমরা কী পেয়েছি, কী পাইনি, সাদামাঠা হলেও তার একটা হিসাব করা দরকার। একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার কিছু লক্ষ্য থাকে, যা আমাদেরও ছিল। স্বশাসন, সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং সে সংগ্রামে আমরা বিজয়ী হয়েছি। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ও জনসমর্থিত লক্ষ্যগুলো অর্জিত না হলে এ বিজয়কে সার্বিক অর্থে বিজয় বলে চিহ্নিত করা যায় না। সত্য বটে, পরাধীনতা ও পরশাসন থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকেও আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সে মুক্তি আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পরিপ্রেেিতই নতুন করে মুক্ত ও স্বাধীন হওয়ার লড়াইয়ে আমাদের অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে প্রত্যাশিত মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আজকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সেই ৭১-এর জাতীয় ঐক্য বলতে গেলে তিরোহিত। জাতির মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েছে। অপরাজনীতির চর্চা ব্যাপকতা লাভ করেছে। এটা জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। কে না জানে, গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ’৭০-এর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তৎকালীন সরকার তা মেনে না নিয়ে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করেছিল এবং দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল, যা থেকে সূচনা হয়েছিল, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতার উৎস। অথচ, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই করতে হচ্ছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা পারিনি। জনগণের ভোটের অধিকার আজ অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র উপায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেই নির্বাচনসহ সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক বিভক্তি, দুর্নীতি, জবরদস্তির অভিযোগ স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। দেশ এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, রিজার্ভ-ঘাটতি, পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক স্ফীতি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব, বিনিয়োগশূন্যতা ইত্যাদিতে মানুষের উদ্বেগ ও কষ্টের শেষ নেই। এসব সমস্যা ও সংকট নিরসনে যখন সকলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তরিক প্রয়াস চালানো দরকার, তখন আমরা হিংসা-বিদ্বেষে মত্ত। এ সময় আমাদের পেছনে নয়, বরং সামনে তাকানো প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
স্বাধীনতার আকাঙ্খা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে, উন্মুক্ত রাজনীতি, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ও দুর্নীতি রোধ করা অপরিহার্য। গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিরন্তর প্রয়াস চালানো প্রয়োজন। এখন বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্রের কথা অনেকে বলেন। এতে মনে হতে পারে, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বুঝি পরস্পরবিরোধী। মোটেই তা নয়। আমাদের গণতন্ত্র যেমন দরকার, তেমনি উন্নয়নও দরকার। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্রে উন্নয়ন সুষম ও দ্রæতায়িত হয়। বিগত সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবয়ন করেছে। নিসন্দেহে এসব প্রকল্প জাতীয় উন্নয়ন ও কল্যাণকে অনেক দূর এগিয়ে দেবে। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গণতন্ত্র কোনো বাধা নয়, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে তা হবে উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা এবং গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা ব্যবস্থা করা জরুরি। সঙ্কুচিত গণতন্ত্র দেশে টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে ওঠে। দুঃখের বিষয়, বিগত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনীতিতে এখনো গুরুতর সংকট চলছে। সেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বদলে প্রতিহিংসার চর্চা হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দেশে সংস্কার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছেছে। অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐক্য, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সুবিচারের নিশ্চয়তা ও সুশাসনই কেবল দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশ এক অমিত সম্ভাবনার দেশ। সম্পদ, শক্তি ও উদ্যমে ভরা দেশটি ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। দ্রæতই মধ্যম ও উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই চলা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা পেছনে হাঁটতে চাই না, সামনে এগিয়ে যেতে চাই। জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রধান দায়িত্ব রাজনীতিকদের। আমরা আশা করতে চাই, আমাদের সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুভবুদ্ধি, বিচণতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক:
শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া
সহযোগী সম্পাদক: তোফায়েল আহমেদ
অফিস: সম্পাদক কর্তৃক আজমিরী প্রেস, নিউমার্কেট চান্দিনা প্লাজা, কুমিল্লা থেকে মুদ্রিত ও ১৩০৭, ব্যাংক রোড, লাকসাম, কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত। ফোন: ০২৩৩৪৪০৭৩৮১, মোবাইল: ০১৭১৫-৬৮১১৪৮, সম্পাদক, সরাসরি: ০১৭১২-২১৬২০২, Email: laksambarta@live.com, s.bhouian@live.com