শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমাদের শৈশবের ঈদ

এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী

            তখনো তথ্যপ্রযুক্তির এতো উন্নতি হয়নি। গ্রামে বিনোদন বলতে যাত্রাপালা, কবিগান বা উঠোনে বসে বড়দের মুখে কেস্ছা-কাহিনী শোনা। আশ্বিন-কার্ত্তিক মাসে কৃষকদের হাতে কোন কাজ থাকতো না। বৃস্টি কমে আসতো। বন্যার জলও ধীরে ধীরে নামতে শুরু করতো। মেঘমুক্ত নীলাভ আকাশ সোনালি রোদ্দুরে হেসে উঠতো। আমন ধানের শীষে একটু একটু করে রঙ্গ ধরতে শুরু করেছে। অনাগত ফসলের স্বপ্নে বিভোর কৃষকরা অভাব অনটন ভুলে মেতে উঠতো আনন্দ-বিনোদনে। এ সময় পালা গানের আসর বসতো। সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, গহর বাদশা বানেসা পরী, মনোহর মধুমালতী, রূপবান, গুনাই বিবি, কাঞ্চন মালা, আলোমতি প্রেমকুমার – ইত্যাদি সব পালা। রাত শেষ হয়ে যেত রাজকন্যা রাজপুত্রের মিলন হতো না বা রাসের হাত থেকে রাজকন্যা উদ্ধার হতো না। ফজরের আজানের আগে পালা শেষ হলে ঢুলু ঢুলু চোখে ঘরে ফিরে বড়দের সেকি বকুনি।

            রেডিও এসেছে অনেক পরে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়ির উঠোনে বিরাট জটলা। টেবিলের ওপর একটি ছোট বাক্স। একে ঘিরে অসীম আগ্রহ নিয়ে বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাই। আমার এক মামা তখোন চেয়ারম্যান। এ যাদুর বাক্সটি তিনিই ঢাকা থেকে এনেছেন। কে যেন দু’টি বাঁশের মাথায় এটি জাল বেঁধে সে জালের মাঝামাঝি থেকে একটি সরু তার এনে বাক্সটার মাথায় বেঁধে দেন। সবাই আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি কি হতে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। মামা বাক্সটির একটি নব ঘুরাতেই গান বেজে ওঠলো। আমরা তো হতবাক। সারা গ্রামে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এ যাদুর বাক্সটি দেখার জন্য দূরদূরন্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতো।

            শৈশবের সে স্বপ্নঝরা দিনগুলোতে  আমাদের জীবনে ঈদ আসতো অফুরন্ত আনন্দের প্রানবন্যা নিয়ে। গ্রামের মানুষজনের অবস্থা এখনকার মতো এতো সচ্ছল ছিলো না। তবে সর্বত্রই প্রাণের প্রাচুর্যে ভরপুর ছিলো। রোজার পনেরটি গেলেই আমাদের ছোটদের মধ্যে শুরু হতো অস্থিরতা । কখন হাঁটে যাবো, সার্ট প্যান্টের কাপড় কিনবো। কুড়ি তারিখের পর টেইলাররা আর অর্ডার নেবে না। তাই এতো তাড়াহুড়া। এখনকার মতো রেডিমেট গার্মেন্টসের প্রচলন ছিলো না। থাকলেও শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আমার বাবা পশ্চিম পাকিস্তান থাকতেন। তিনি ঈদের আগেই পার্শ্বেলে সুন্দর সুন্দর কাপড় চোপড় পাঠাতেন। রোজার শুরতেই যেদিন বাবার চিঠি পেতাম, সেদিন থেকেই ঘুমনিদ হারাম হয়ে যেত। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পোস্টাফিসে ঢু মারা চাই। তারপর কাঙ্খিত সে দিনটিতে যখোন পার্শ্বেলটি হাতে পেতাম, সে কি আনন্দ ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সাদা ড্রিল কাপড়ে মোড়া পার্শ্বেল লাল খয়েরি রঙ্গের গালা সীল। বার বার শুখে দেখতাম। সীমাহীন আগ্রহ নিয়ে বাড়ি এনে প্যাকেটটি খুলে বাহারী রঙ্গের কাপড় দেখে বুকটা আনন্দে ভরে ওঠতো। এরপর ছুটো টেলারের কাছে।

            ঈদ ঘনিয়ে আসছে। বারবার টেলারের দোকানে গিয়ে তাগাদা দেই। তারাও ব্যস্ত। ঈদের দু’একদিন আগে জামা কাপড় হাতে আসতো। কয়লার ইস্ত্রিতে ইস্ত্রি করা সার্ট প্যান্ট প্যাকেটে পুরে বাক্সে লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের আগে কাউকে দেখানো যাবে না। কতোজন কতো অনুনয় করতো, তারপরেও দেখাতাম না।  রাতের বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে দেখতাম। আজকের শিশুরাও দেখছি এমনি করে। এ বিষয়টি আগের মতোই আছে।

ঈদের আগের রাত। বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই। মহিলারা চালের গুড়ো দিয়ে অপূর্ব শৈল্পিক ভঙ্গিতে সেমাই পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ নারিকেল ভাঙ্গছে তো কেউ এ ঘর ও ঘর ছুছোছুটি করছে। কেউ হয়তো শহর থেকে এ মাত্র ফিরেছে। তাকে নিয়ে জটলা। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বড়দের গল্পগুজব চলছে। মাঝে মাঝে দু’একখানা গানও শোনা যেত। যাদের বাড়িতে কলের গান ছিলো, তাদের বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসতো। আর আমরা ছোটরা তো হৈ হল্লা করে বাড়ি মাথায় তুলতাম। আজ আর কেউ বকা দিত না।

ঈদের আগের সন্ধ্যাটা ছিলো খুব মজার। সবাই দল বেঁেধে ঈদের চাঁদ দেখতাম। ঈদের চাঁদ দেখলে গ্রামে আতসবাজী ফুটানোর রেওয়াজ ছিলো। গ্রামে আতসবাজী ফুটিয়ে সারা এলাকায় চাঁদ দেখার জানান দিয়ে আশপাশের সব গ্রামকে জাগিয়ে দিত। স্বপ্নের ডানায় ভর করা রাত এক সময় শেষ হতো। খুব ভোরে ভোরে ঘুম থেকে ওঠতাম। শীত হোক আর গ্রীষ্ম বর্ষা যাই  হোক গোসল করা চাই। তারপর মাথায় জবজব করে তেল দিয়ে মাথা আঁচড়িয়ে নতুন পোষাক পরে বড়দের সালাম করে সালামী নেয়ার পালা। দু টাকা একটাকা সালামী তো রাজকীয় ব্যাপার। ছোটবেলা হাফপ্যান্ট  সার্ট বা লুঙ্গিই পেয়েছি বেশী। পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠেই প্রথম পাঞ্জাবী পেয়েছি। এ পাঞ্জাবি পরার স্মৃতি এখনো খুব মনে পড়ে।

            সেবার ঈদ হয়েছিলো বর্ষায়। পথঘাট ভারী পিচ্ছিল। ঈদগাহে যাবার রাস্তাটুকু ছিলো ভাঙ্গাচোরা। স্থানে স্থানে গর্ত। মাঝে মাঝে বাঁশ ফেলে পুল তৈরি করা হয়েছে। বড়দের সঙ্গে ঈদগাহে যাচ্ছি। নখ টিপে টিপে অনেকটা পথ পেরিয়ে যে সাঁকোতে ওঠেছি, অমনি কে যেন পেছন থেকে সাঁকোতে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। বৃদ্ধের দাঁতের মতো নড়বড়ে সাঁকো। আমাদের ভার সামলাতে পারলো না। আমরা হুড়মুড় করে পানিতে পড়ে যাই। সাধের পাঞ্জাবির অবস্থা জলকাদায় একেবারে নাজুক। আবার বাড়ি ফিরে নতুন কাপড় পরে ঈদগাহে দেই ছুট। এখন সে রাস্তা পাকা হয়েছে। রিক্সা, সিএনজি, মাইক্রো চলে। কত পরিবর্তন!

            ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে ঘরে ঘরে পিঠা পায়েস সেমাই খাওয়ার ধুম। এঘর সে ঘর সব ঘরেই খেতে হতো। কোন ঘরে  না গেলে ওদেরকে অবহেলা করছি মনে করতো। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে প্রতিটি মানুষের কী অপূর্ব সম্পর্ক ছিলো তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। আজকাল এমন সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক কোথাও দেখা যায় না। রাজনীতি আর স্বার্থের দ্ব›েদ্ধ কেউ এ দল কেউ সে দল। সন্ধ্যায় স্কুল মাঠে নাটক। সবাই দল বেঁধে নাটক দেখে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতাম। আজ আর বকাসকা নেই। কারন, যারা বকবে তারাও আমাদের সঙ্গে নাটক দেখেছেন।

            একালের ঈদে জৌলস আছে, চাকচিক্য আছ্।ে কিন্তু প্রাণের স্পর্শ নেই। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের রসরুচির পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরিবর্তন হয়েছে মানুষের ভাবনা চিন্তা আর আবেগের। তাই আজকের ঈদে আগের মতো প্রাণের ছোঁয়া কোথাও পাই না। সব জায়গায় যেন কৃত্রিমতা আর মেকীপনা। লোক দেখানোর প্রতিযোগিতা। ফেলে আসা সে সোনালি দিনগুলোর কথা আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে বলি। ওরা যেন অবিশ্বাসের চোখে আমাদের দিকে তাকায়। মনে মনে হয়তো ভাবে এদেশে কি এমনও ছিলো?

      লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ও কথাসাহিত্যিক

Share This