শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ই’তিকাফ ঃ তাৎপর্য ও গুরুত্ব

            অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইউনূছ \ রমযান মাস বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ তায়ালার অশেষ নিয়ামত। এ মাস রহমত, মাগফিরাত, নাজাত, কল্যাণ ও সৌভাগ্যে পরিপূর্ণ। চন্দ্র মাসের মধ্যে এ মাস সম্মানিত ও মর্যাদা মন্ডিত হওয়ার পেছনে যে কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তা হচ্ছে- রোযা পালন, মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল, লাইলাতুল ক্বদর ও ই’তিকাফ। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হলো মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভ। এ ক্ষেত্রে ই’তিকাফ মাইলফলক হিসাবে কাজ করে। কারণ ই’তিকাফ এমন এক বৈধ নির্জনতা যেখানে ব্যক্তি আল্ল­াহর ইবাদত তথা নামাজ, রোযা, জিকির, তাসবীহ-তালীল, কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামী জ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় নিজকে সম্পূর্ণ ব্যস্ত রাখে এবং আনুগত্য ও শপথের উদ্দেশ্যে স্বীয় আত্মা ও সত্ত¡াকে একান্তভাবে নিয়োজিত করার মাধ্যমে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভে প্রাণবন্ত চেষ্টা করে।

            ই’তিকাফের পরিচয়ঃ ই’তিকাফ শব্দটি আরবী। আক্ফ ক্রিয়া মূল থেকে গঠিত। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- অবস্থান করা, আটকে রাখা, নিজকে বন্দি করা, মসজিদে অবস্থান করা, নির্দিষ্ট সময় বা গন্ডিতে অবস্থান করা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে- রোযা অবস্থায় নিয়্যত সহকারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তির মসজিদে বা নির্দিষ্ট গন্ডিতে অবস্থান করা।

            ই’তিকাফের হেকমত ঃ আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব (রঃ) বলেন- ই’তিকাফের হিকমত বা উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সাথে বান্দার পরিচয় যত গভীর হবে, সম্পর্ক ও ভালবাসা তত বৃদ্ধি পাবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ সুগম হবে।

            আল্লামা ইবনে কাইয়ুম (রঃ) বলেন, ই’তিকাফের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা যেন সব দিক থেকে একমাত্র তাঁরই সঙ্গে একত্র হওয়া যায় এবং তিনি ব্যতিত সব কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁর মধ্যেই ডুবে যাওয়া। আর যাবতীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তাঁরই পবিত্র সত্ত¡ায় মগ্ন হওয়া ও ধ্যান ধারণাসহ সর্বত্রে তাঁর পবিত্র জিকির ও মুহব্বতকে স্থান দেয়া এমনকি তামাম সৃষ্টিকুলের ভালবাসার পরিবর্তে যেন আল্লাহ পাকের সাথে ভালবাসা সৃষ্টি হয়ে যায়।

            ই’তিকাফের ফজিলত ও গুরুত্ব ঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ই’তিকাফ করে আল্লাহ পাক তার ও দোযখের মধ্যে ৩ খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করেন” (তিবরানী ও হাকেম)। আলী ইবনে হুসাইন (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি রমযানে ১০দিন ই’তিকাফ করে, তা দু’হজ্জ বা দু’ওমরার সমান” (বায়হাকী)। হযরত ইবনে আব্বার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ই’তিকাফকারী সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন- “ই’তিকাফকারী গুনাহ থেকে দূরে থাকে। তাকে সকল নেক কাজের কর্মী বিবেচনা করে বহু সওয়াব দেয়া হবে” (ইবনে মাজাহ্)। রাসূল (সাঃ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি খালেস নিয়তে খাঁটি ঈমানে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ই’তিকাফ করবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” উপরোক্ত হাদীসগুলোর মাধ্যমে ই’তিকাফের মহত্ব ও ফযিলত দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।

            ই’তিকাফের হুকুম ঃ ই’তিকাফ সুন্নত। রমযানের শেষ ১০ রাতে ক্বদরের রাত অণ্বেষণে ই’তিকাফ করার বিধান চালু হয়েছে। কিন্তু ই’তিকাফের মান্নত করলে তা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) বলেন, “কারো মান্নত যদি আল্লাহর আনুগত্যের জন্য হয় তা যেন পূরণ করে” (বুখারী ও মুসলিম)। রমযান ছাড়াও যে কোন সময়ে মসজিদে অনির্ধারিত সময়ব্যাপী ই’তিকাফ করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আমার ঘরকে তাওয়াফ ও ই’তিকাফের জন্য পবিত্র রাখ।” হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত- “রাসূল (সাঃ) আমৃত্যু রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন” (বুখারী ও মুসলিম)।

            ই’তিকাফ অবস্থায় করণীয় ঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ই’তিকাফ অবস্থায় করা মুস্তাহাব। যেমন-

১.    বেশি বেশি নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, দ্বীনি জ্ঞান চর্চা ও গবেষণা করা, মাসনুন দোয়া ও জিকির করা, নবী করীম (সাঃ) এর উপর দুরূদ পড়া এবং ওয়াজ নসিহত করা।

২.    কল্যাণকর কথা ছাড়া বাজে কথা না বলা, ঝগড়া বিবাদ এবং গালমন্দ না করা।

৩.   মসজিদের একটি অংশে অবস্থান করা। নাফে (রঃ) থেকে বর্ণিত- “আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) আমাকে মসজিদে নববীতে রাসূল (সাঃ) এর সুনির্দিষ্ট স্থানটি দেখিয়েছেন” (মুসলিম)।

            ই’তিকাফ অবস্থায় বর্জনীয় ঃ ই’তিকাফ অবস্থায় নিম্নোক্ত কাজগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। যেমন-

১.    জরুরী কাজ যেমন- পেশাব, পায়খানা, গোসল, খাদ্য, পানীয় ইত্যাদি ব্যতিত মসজিদের বাইরে না যাওয়া। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন- “ই’তিকাফকারীর জন্য সুন্নত হলো রোগী দেখতে না যাওয়া, জানাযায় অংশগ্রহণ না করা, স্ত্রী স্পর্শ না করা এবং স্ত্রী সহবাস না করা” (আবু দাউদ)। তিনি আরো বলেন- “রাসূল (সাঃ) মসজিদে ই’তিকাফ করতেন। তিনি হুজরার ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন আর আমি তাঁর মাথা সিথি করে দিতাম” (বুখারী ও মুসলিম)।

২.    স্ত্রী সম্ভোগ অথবা সম্ভোগের প্রতি আকর্ষণীয় বিষয় যেমন চুমো দেয়া অথবা যৌন উত্তেজনার সাথে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তোমরা মসজিদে ই’তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না” (সুরা বাক্বারা-১৮৭)।

৩.   সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ যেমন- হিংসা, বিদ্বেষ, গীবত, খারাপ আকিদা প্রতৃতি থেকে বিরত থাকা।

৪.    ই’তিকাফ অবস্থায় পার্থিব কাজ যেমন- বিনা প্রয়োজনে ব্যবসা বাণিজ্য, কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম প্রভৃতি থেকে বিরত থাকা।

            ই’তিকাফের উপকারিতা ঃ প্রকাশ থাকে ই’তিকাফ এ বহু উপকারিতা রয়েছে। এ ব্যপারে বায়তুল শরফের মরহুম পীর মহান সাধক মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জাব্বার সাহেব বলেন,

ই’তিকাফের মধ্যে দিল আল্লাহ ব্যতিত অন্যসব কিছু থেকে খালি হয়ে কেবল মাত্র আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকে।

            ই’তিকাফকারী মানুষের সংশ্রব থেকে দূরে থেকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পায়। ই’তিকাফের মধ্যে আল্লাহর সাথে বান্দার খাঁটি প্রেম ও মহব্বত দূঢ় হয়। ই’তিকাফের মধ্যে আল্লাহর উপর ভরসা ও অল্পে তুষ্টির মনোভাব সৃষ্টি হয়। ই’তিকাফ দ্বারা মানুষ সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকে। ই’তিকাফ দ্বারা মানুষ আল্লাহর রহমত পাবার যোগ্যতা অর্জন করে। যেমন- হযরত মূসা (আঃ) “৪০ দিন ই’তিকাফ করার পরই তাওরাত লাভ করেন। আর নবীকুলের শিরমণি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) গারে হেরার মধ্যে ৬ মাস ই’তিকাফ করার পরই নবুয়ত লাভ করেন।”

            পরিশেষে বলা যায় যে, ই’তিকাফ কিছুতেই বৈরাগ্যেবাদ নয়। কেননা বৈরাগ্যবাদ স্থায়ী জিনিস আর ই’তিকাফ হচ্ছে সাময়িক। তাই আমাদের উচিত রোযা, তেলাওয়াত, ই’তিকাফ ও ইবাদতের মধ্য দিয়ে পবিত্র মাহে রমযান অতিবাহিত করা। যাতে রমযান যে সওগাত নিয়ে এসেছে তা সঠিকভাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণে বাস্তবায়ন করতে পারি। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে মাহে রমযানে রোযার পাশাপাশি ই’তিকাফ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য করুক, আমিন।

            লেখক: অধ্যক্ষ, আল আজহার জামেয়া ইসলামীয়া বাংলাদেশ, পদুয়ার বাজার, বিশ্বরোড, মহানগর, কুমিল্লা।

Share This

COMMENTS