শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৪৬ সাংবাদিক নিহত  ‘ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে ইসরায়েলের  এক শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের মধ্যেই রয়েছে’

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৪৬ সাংবাদিক নিহত ‘ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে ইসরায়েলের এক শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের মধ্যেই রয়েছে’

          শহীদুল্লাহ ভূঁইয়াঃ চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে তেল আবিবের নিষেধাজ্ঞার মাঝে গাজায় ওষুধপত্র, খাদ্য, পানি ও জ্বালানিসহ প্রায় সবকিছুরই তীব্র সংকটে এক হাহাকার অবস্থা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজায় পানির পাশাপাশি জ্বালানি তেলেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অঞ্চলটিতে ডিস্যালিনেশন প্ল­্যান্ট এবং পানির পাম্প চালানো সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ প্রাপ্তির জন্যও জেনারেটরের জরুরি প্রয়োজন মেটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

            গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুত্র মতে, গত ৩০ দিনে ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯ হাজার ৭৭০ জনেরও বেশী ফিলিস্তিনি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন লাখো মানুষ। নিহত ও আহত এসব ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তদুপরি গতকাল মঙ্গলবার আবারও শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলায় আরো কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন বলে রয়টার্স-এর খবরে বলা হয়েছে। আর ইসরায়েলের এই নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের লাগাম টানা নিয়ে এখনো কিছুটা বিপরীত মেরুতে রয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা আরব বিশ্ব। এর মধ্যেও গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে আরব দেশগুলো জোরে শোরেই। তবে এতে করেও এখনো কোনো ফলপ্রসূ ফায়দা হয়নি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিয়ে এসব দাবী একটার পর একটা প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।

            এর মধ্যে গত রোববার পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৈঠকে গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান আব্বাস। তবে মানবিক সহায়তা সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুই বলেননি। ওদিকে, গেল মঙ্গলবার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে গাজাবাসীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কারণেই এবার পূণরায় এমন ঘটনার সুত্রপাত হয়েছে। এ ব্যাপারে গুতেরেস বলেছেন, ‘এটি স্বীকার করে নিতেই হবে যে, ইসরায়েলে হামাসের হামলা এমনিতেই হয়নি। কারণ ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরেই এক শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের মধ্যে রয়েছেন।’

            ‘তারা দেখেছেন- তাদের ভূখন্ড সুষ্ঠ মাথায় এবং স্থিরভাবেই গ্রাস করা হচ্ছে। তারা নজির বিহীন সহিংসতায় জর্জরিত হয়েছে। তাদের অর্থনীতির গলা টিপে রাখা হয়েছে, তাদের বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে এবং বাড়ি-ঘর তছনছ করা হয়েছে। আর এহেন রাজনৈতিক সমস্যার যে আশা তাদের ছিল- সেটি দিনের পর দিন শুধু ক্ষীন হয়ে যাচ্ছে।’

তবে জাতিসংঘের মহাসচিব সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা দিয়ে হামাসের হামলাকে বৈধতা দেয়া যাবে না। সঙ্গে হামাসের হামলার জন্য ফিলিস্তিনিদের সমষ্টিগত শাস্তির বিষয়টিকেও বৈধতা দেয়া যাবে না। মহাসচিব আরও বলেছেন, ‘এ ধরনের কঠিন মুহূর্তে, নীতির উপর ঠিক থাকা খুবই জরুরি। বেসামরিকদের সম্মান ও রক্ষার নীতির মাধ্যমে যেটি শুরু।’

            অবশ্য, জাতিসংঘের মহাসচিব গাজায় ত্রাণ সরবরাহের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন, “তবে যে পরিমাণ ত্রাণ এখন গাজায় ঢুকছে- সেগুলো বিশাল সমুদ্রের পানির একটি ছোট ফোটার সমান।”

            তবে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদে এমন বক্তব্য দেয়ার পর এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের দূত গিলার্ড  ইর্ডান বলেছেন, গুতেরেসের এ বক্তব্য ‘জঘন্য’ এবং ‘ভয়ানক’ এবং এটির সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

            মহাসচিব গুতেরেসের সমালোচনা করে ইসরায়েলি দূত আরও বলেছেন, ‘তার এ মন্তব্য সন্ত্রাসবাদ এব হত্যাকে বৈধতা দেয়ার সামিল। এটি খুবই দুঃখজনক!

            ওদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রøাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘মার্কিন নীতির ব্যর্থতার কারণেই ইসরায়েল-হামাস-এর মধ্যে এই যুদ্ধ! ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার ফলাফল হিসেবে বর্ণনা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রøাদিমির পুতিন। সম্প্রতি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানির সঙ্গে এক বৈঠকে এ কথা বলেছিলেন তিনি।

            পুতিন বলেন, ‘আমি মনে করি, অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যর্থতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।’ তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘একচেটিয়া’ বানানোর চেষ্টা করেছে ওয়াশিংটন। পুতিন আরও অভিযোগ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমঝোতার বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং দ্ব›দ্ব সমাধানে নিজেদের পরিকল্পনাগুলোই ঠেলে দিয়েছে।’

            স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিসহ ফিলিস্তিনিদের স্বার্থগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছে বলেও অভিযোগ করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তবে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে কিছু উল্লেখ করেননি পুতিন।

            উল্লেখ্য, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাশাপাশি ২০০২ সাল থেকে একটি ‘চতুর্থ শক্তি’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে মস্কো।

            ওদিকে, পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ক্রেমলিন ইসরায়েল এবং গাজার যুদ্ধরত উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং সংঘাতের সমাধানে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করবে। তবে এটি কীভাবে সম্ভব হবে, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি তিনি। পেসকভ বলেন, ‘আমরা সমাধানের উপায় খুঁজতে সহায়তা প্রদানে আমাদের ভূমিকা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই।’

এছাড়া, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রøুাদিমির পুতিন গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মমতার বিরুদ্ধে আবারও জোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গাজায় সহিংসতায় হতাহত শিশু-নারী ও বেসামরিক লোকজনকে দেখেও যাদের প্রাণ কেঁদে না ওঠে, তাদের হৃদয় পাথরের তৈরি।” মস্কোতে এক উচ্চ পর্যায়ের সরকারি বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেছিলেন।

            রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘একটি স্ফুলিঙ্গ কিংবা গোলা নিক্ষেপ করা সহজ, খুবই সহজ; কিন্তু তারপর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়- আপনি যদি স্বাভাবিক মানুষ হন, তাহলে যখন হামলায় রক্তাক্ত শিশুদের যন্ত্রণা আপনি নিজের চোখে দেখবেন, সে সময় আপনার হাতের মুঠো দৃঢ় হবে এবং চোখ অশ্রæতে ভরে উঠবে। সাধারণ লোকজনের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে থাকে।’

            তিনি আরও বলেন, ‘গাজায় এসব ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পরও যারা স্বাভাবিক রয়েছে, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না- তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও আসলে তাদের হৃদয় নেই। যদি থেকেও থাকে তাহলে সেই হৃদয় রক্ত-মাংসের নয় বরং পাথরের তৈরি।’

তাছাড়া, গাজায় ধ্বংসযজ্ঞকে কোনো কোনো পক্ষ সহিংসতার দিকেই উস্কে দিতে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারেও সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রøুদিমির পুতিন।

            ওদিকে, টানা এক মাস যাবত অব্যাহত ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধে একের পর এক চলছে হামলা পাল্টা হামলা। এমন পরিস্থিতিতে এই যুদ্ধ যাতে আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে না পড়ে- এজন্য চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বলেও জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন।

            জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে কাজ করবে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য এবং বিশেষ করে স্থায়ী সদস্যদের এ যুদ্ধ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য তিনি চীনের সাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি ইসরায়েলকে ব্যাপক অস্ত্র সহায়তা দিলেও দেশটিতে গাজায় স্থল অভিযানে মত দিচ্ছে না। তাদের দাবি, গাজায় পুরোদমে স্থল অভিযান শুরু হলে পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে মোড় নেবে।

            যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গাজায় স্থল অভিযানের ফলে ইসরায়েলের জিম্মি ও বেসামরিক লোকদের বিপদে ফেলতে পারে। এ ছাড়া এ অভিযানের ফলে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়বে। এজন্য তারা বিমান হামলা ও বিশেষ লক্ষ্যে স্পেশাল অপারেশন চালানোর তাগিদ দিয়েছে।

            যুক্তরাষ্ট্র আরও বলছে, ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযান করলে ইরাকের মসুল শহরের মতো হামাসও বেসামরিক লোকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এতে করে পরিকল্পনার চেয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

            ওদিকে, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল। এরমধ্যে রয়েছে সেখানে একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো। ওই বাহিনীতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের সেনারা। এভাবে হামাসের হাত থেকে আস্তে আস্তে গাজাকে বের করে আনতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো।

            খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইল গাজায় অভিযান চালানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। কিন্তু এই অভিযান ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর জন্যেও ব্যাপক রক্তক্ষয়ী হতে পারে। কারণ গাজার মধ্যে ইসরাইলি বাহিনীকে ঠেকাতে প্রস্তুত রয়েছে হামাস যোদ্ধারা। ফলে তাড়াহুড়া করে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিকল্প চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। দ্বিতীয় আরেকটি অপশনের কথাও ভাবা হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে মিশর-ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী গাজায় এই দুই দেশের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা।

            আর তৃতীয় আরেকটি অপশন ভাবা হচ্ছে- যেখানে গাজাকে জাতিসংঘের অধীনে দিয়ে দেয়া হবে।

            সূত্রগুলো জানিয়েছে, এখনও এই আলোচনা প্রাথমিক ধাপে রয়েছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওই মঙ্গলবার একটি সিনেট প্যানেলকে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজার ভবিষ্যত নিয়ে বেশ কয়েকটি অপশনের কথা যাচাই করে দেখছেন। তিনি বলেন, হামাস আবারও গাজা শাসন করবে, এটা আমরা আর দেখতে চাই না। সাম্প্রতিককালে একাধিকবার ইসরাইল সফর করেছেন ব্লিঙ্কেন। তখন ইসরাইল বার বার জানিয়েছেন যে, তারা গাজা শাসন করতে চায় না। কিন্তু একইসঙ্গে তারা হামাসের শাসন মেনে নিতেও রাজি নয়। আবার পশ্চিম তীরের দায়িত্বে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও গাজা শাসনের বিষয়ে কখনও আগ্রহ দেখায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

            আবার গাজায় ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব’ নিয়ে ইসরায়েলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এবার জর্ডানে গিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। রাজধানী আম্মানে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার মধ্যেই এ বৈঠক হয়েছে। ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর-এর খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানী আম্মানে পৌঁছেছেন ব্লিঙ্কেন। পৌঁছানোর পর শনিবার জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। সেখানে মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্লিঙ্কেন। এসময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ- পিএ এর একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।

            ওদিকে, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, এই বৈঠকে আরব নেতাদের চাপের মুখে পড়েন ব্লিঙ্কেন। তারা গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানান এবং হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে, এতে তারা সমর্থন জানাননি।

            বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন ব্লিঙ্কেন। রুমভর্তি সাংবাদিকদের উদ্দেশে ব্লিঙ্কেন বলেন, আরব নেতাদের সৌজন্য এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি কৃতজ্ঞ। আরব নেতাদের মতো তিনিও চান এই যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং এই অঞ্চলে একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আসুক। আর গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় তিনি মিসরকে ধন্যবাদ জানান।

            ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের আরও জানান, গাজা-মিসরের সীমান্তবর্তী রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় আজও ১০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আরও জানান, তাদের প্রধান লক্ষ্য হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্ত করা।

            ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তবে আত্মরক্ষার নামে অভিযান চালানোর সময় যেন বেসামরিক মানুষ হতাহত না হন, সেদিকে ইসরায়েলকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, গাজায় এই অভিযান অব্যাহত রাখার মাধ্যমে হামাসকে দমন করা সম্ভব হবে। এতে করে হামাস ইসরায়েলে দ্বিতীয়বারের মতো আর কখনো হামলা চালাতে পারবে না।

  মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে বলেন, যখন তিনি দেখতে পান ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে গাজার শিশুদের টেনে তোলা হয়; তখন সে দৃশ্য তার মনে নিজের সন্তানদের মুখচ্ছবি জাগিয়ে তোলে।

            তিনি জানান, তাদের সবাইকে একে অপরের প্রতি মানবিক হতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো গাজায় কোনো যুদ্ধবিরতি চায় না বলে জানিয়েছেন ব্লিঙ্কেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধবিরতি করলে হামাস আবার সংগঠিত হবে এবং বিগত ৭ই অক্টোবরের মতো হামলা চালাবে।

            ব্লিঙ্কেনের পর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ সোরকি। তিনি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানান। এ ছাড়া তিনি দ্বিমুখী ও ভন্ডামি না করতে পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন ফিলিস্তনিদের ওপর অত্যাচার হয়, তখন এ নিয়ে অন্যগুলোর মতো একই প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় না। বিষয়টি যেন এমন, আরবদের রক্ত অন্যদের রক্তের চেয়ে কম দামি।’

            জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, কোনো ধরনের হত্যাকান্ড গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া এটি কোনো ধর্মীয় যুদ্ধ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

            এই সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে এক সাংবাদিক ব্লিঙ্কেনকে জিজ্ঞেস করেন, গাজায় ১০ হাজার মানুষ হত্যা করে ইসরায়েল কী অর্জন করেছে। এর জবাবে ব্লিঙ্কেন বলেছেন, কোনো দেশই তার বেসামরিকদের হত্যার বিষয়টি মেনে নিত না। তবে হামাস বেসামরিক মানুষদের মধ্যে লুকিয়ে থাকায়, অস্ত্র মজুদ করায় বেশি ফিলিস্তিনি হতাহত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।

            ওদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সম্প্রতি ফোনালাপকালে অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন বাদশাহ আবদুল্লাহও। ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীরের সীমান্তবর্তী দেশ জর্ডান। দেশটির রাজধানী আম্মানে গাজাবাসীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গত শুক্রবার প্রায় ৫ হাজার জর্ডানিয়ান বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এসময় রাজাকে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইরায়েলকে চাপ দেওয়ার আহ্বানও জানান তারা।

            এর আগে, বুধবার গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইসরায়েল থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন জর্ডান।

            ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলকে মার্কিন সহায়তা বন্ধ করার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

            গত শনিবার (৪ঠা নভেম্বর) দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিক্ষোভকারীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘বাইডেন, বাইডেন, আপনি লুকাতে পারবেন না; আমরা আপনাকে গণহত্যার অভিযুক্ত করব।’

ইসরায়েলি হামলায় গাজায়

৪৬ সাংবাদিক নিহতঃ

            ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলায় অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত: ৪৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরুর পর গত ৭ই অক্টোবর থেকে গাজায় অব্যাহত বোমা হামলা ও পরবর্তীতে স্থল হামলা শুরু করে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। বেসামরিক সাধারণ মানুষের মতো ইসরায়েলি সেনাদের এসব হামলার কবলে পড়ে প্রাণ গেছে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকদেরও। অথচ, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গাজায় সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছেন এসব সাংবাদিকরা।

            গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের একজন মুখপাত্র  আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্ন তোলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা কোথায়? কেন তারা গাজার সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মকর্তারা যে শত্রæতার মুখোমুখি হচ্ছেন সে সম্পর্কে কথা বলছেন না? ওই মুখপাত্র বলেন, গাজায় আক্রমণ করার ক্ষেত্রে সব ধরনের সীমা অতিক্রম করা হয়েছে। এসব অপরাধ নথিভুক্ত করা হয়েছে।

            তিনি বলেন, আমরা অসংখ্য দাবির একটি তালিকা তৈরি করব না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা যা বলতে চাই তা হচ্ছে, আপনি যদি মানুষ হন এবং আপনি যদি এখানকার লোকদেরকে আপনার মতো মানুষ হিসেবে দেখেন, তবে আপনার মানবতা দেখান এবং যা সঠিক তার পক্ষে দাঁড়ান।

            সংস্থাটি আরও বলেছে, ‘একই সময়ের মধ্যে, ৩৫ জন সাংবাদিকের বাড়ির উপরেও সরাসরি হামলা চালানো হয়েছে। এতে তাদের পরিবারের অসংখ্য সদস্য নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে আল জাজিরার সাংবাদিক ওয়ায়েল দাহদুর বাড়িতে হামলার ঘটনা। ওই হামলায় ওয়ায়েলের স্ত্রী, দুই সন্তান এবং ছোট নাতি নিহত হন।’

            ফিলিস্তিন সাংবাদিক সিন্ডিকেট নামের সংস্থাটি আরও বলেছে, ‘নতুন করে সাংবাদিকদের উপর হামলার বিষয়টি ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের উপর ইসরায়েলের জঘন্য অপরাধের একটি অংশ। এর আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৫ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করেছে। যার মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে শিরিন আবু আকলেহর হত্যাকান্ড অন্যতম।’

            সংস্থাটি ফেসবুকে দেয়া বিবৃতিতে আরও জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় টেলিফোন, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। গাজাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো- রাতের আঁধারে সেখানে গণহত্যা চালানো।

            প্রকাশ থাকে যে, সিপিজের তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব সাংবাদিক মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হন হামাস-সমর্থিত রেডিও আল-আকসার। এই সংবাদমাধ্যমের ৭ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, রয়টার্স

গাজায় ৫২টি মসজিদ ধ্বংসঃ

            গত ১ মাসে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে কমপক্ষে ৫২টি মসজিদ। এব্যাপার হামাস প্রশাসনের তথ্য দপ্তরের পরিচালক জানান, গত তিন সপ্তাহে ধ্বংস হয়েছে দুই শতাধিক স্কুল, ৮০টির বেশি সরকারি কার্যালয়, ৭টি গীর্জা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখের বেশি ঘরবাড়ি। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত ৩২ হাজার আবাসিক ভবন।

            এমন কি- সরকারি হিসাব বলছে, ফিলিস্তিনে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রায় ১ হাজার মরদেহ। শুধু শরণার্থী শিবির নয়; স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি কোনো কিছুকেই বাদ দেয়নি ইসরাইলি সেনারা। সুত্র: সংবাদ মাধ্যম আনাদুলু

ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কারণে নিজ ভিটেমাটি হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় দেড় কোটি ফিলিস্তিনিঃ

            ইসরায়েলি বর্বরতা ও দখলদারিত্বের কারণে চলমান যুদ্ধের আগেই নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে শরণার্থী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন এক কোটি ৩৮ লাখ ফিলিস্তিনি। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানিয়েছে ফিলিস্তিন সরকার। দখলদার ইসরাইলের অত্যাচার আর নির্যাতনে গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি লোকসংখ্যা কমে এখন মাত্র ৫২ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

            বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও ইউএনএফপিএ (ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ড) যৌথভাবে ওই পরিসংখ্যানের রিপোর্ট প্রকাশ করে। তদুপরি, অবরুদ্ধ গাজা ও পশ্চিমতীরের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশই শিশু। এদের মধ্যে গাজায় ৪১ শতাংশ বাসিন্দার বয়স ১৫ বছরের নিচে।

            পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গাজায় ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারে ২১ লাখ ১০ হাজার ফিলিস্তিনির বসবাস, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্যতম।

            আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরাইলের অব্যাহত এ দখলদারিত্বের কঠোর সমালোচনা করলেও এতে কর্ণপাত করছে না তেলআবিব। জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন ছাড়াও বহু ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতেও। সেখানে এ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছেন এক ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত নাগরিক। সুত্র: আরব নিউজ

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় প্রতিদিন

হতাহত ৪২০ শিশুঃ

            ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এ সংঘাতের শুরু থেকে গত এক মাসে অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে, ইউনিসেফ-এর হিসেব অনুযায়ী ইসরায়েলি হামলায় গাজায়  গড়ে প্রতিদিন হতাহত হচ্ছে ৪২০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশু। এমন তথ্যই সামনে এনেছে জাতিসংঘের শিশু নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। গত ৩১শে অক্টোবর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

            প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজা উপত্যকায় প্রতিদিন ৪২০ জনেরও বেশি শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে বলে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল জানিয়েছেন।

            জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে তিনি বলেছেন, গাজা ছাড়াও পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে অন্তত ৩৭ শিশু নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আর গাজা উপত্যকায় অন্তত ২০ শিশু বন্দি রয়েছে, তাদের ভাগ্য এখনও অজানা।

            ক্যথরিন রাসেল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এবং সংঘাত-শত্রুতা যদি শেষ না হয়, তাহলে আমি এই অঞ্চলের শিশুদের ভাগ্য নিয়ে দারুন শঙ্কিত।’

            পরে তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে ‘অবিলম্বে’ একটি রেজুলেশন পাস করার আহ্বান জানান। সেখানে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পাশাপাশি গাজায় নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেয়ার দাবি এবং অবিলম্বে বন্দি সব শিশুর নিরাপদ মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ থাকার কথা জানান ক্যাথরিন রাসেল।

            এদিকে, মধ্য গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় আরও অন্তত ১৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি বার্তাসংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, সোমবার রাতে আল-নুসিরাত শরণার্থী শিবিরের একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ওই ১৪ জন নিহত হন। হামলার পর ভুক্তভোগীদের দেইর এল-বালাহের আল-আকসা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। অথচ, নিহত এসব ফিলিস্তিনি গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে এসে এই ক্যাম্পের একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

গাজায় ১৮ হাজার বোমা; হিরোশিমার নৃশংসতাকেও  ছাড়িয়ে গেল ইসরায়েলঃ

            গত ৭ই অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীগোষ্ঠী হামাসের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ১৮ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় ফেলা বোমার তুলনায় প্রায় দেড় গুণ বেশি। গাজায় ইসরায়েলি বোমা ফেলার এই তথ্য জানিয়েছেন অবরুদ্ধ উপত্যকার কর্মকর্তারা।

গাজায় হামাস নিয়ন্ত্রিত সরকারি অফিসের গণমাধ্যমবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা সালামা মারুফ বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ৮৫টি সরকারি ভবন ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি গাজায় ৪৭টি মসজিদ একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং তিনটি গির্জার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে।

            তিনি বলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় ২ লাখের বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৫০০ ভবন পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গাজায় ২০৩টি স্কুলে হামলা চালিয়ে সেগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে। ৪৫টি স্কুল পুরোপুরি পাঠদানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তবে ইসরায়েলের হামলা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পুরো পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অথচ, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো নিষিদ্ধ। কিন্তু ইসরায়েল বলেছে, হামাসের যোদ্ধারা এসব ভবনের ভেতরে অথবা আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে ইসরায়েলি বাহিনী এসব ভবনকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।

            মারুফ বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার ৯০৮টি পরিবারকে একেবারে মুছে দিয়েছে। অর্থাৎ ইসরায়েলি হামলার শিকার এই পরিবারগুলোর কোনও সদস্যই আর বেঁচে নেই।

            গত ৭ই অক্টোবর গাজার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রায় ১ মাস যাবত চলমান এই হামলায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজারে পৌঁছেছে। গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু ও নারী।

            চলমান এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৪২ শিশু ও ২ হাজার ১৮৭ নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ২১ হাজার ৫৪৩ ফিলিস্তিনি। আর হামাসের হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণহানির সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ৩২৬ সৈন্য রয়েছে বলে জানা গেছে। জবভ: উঐঅকঅ চঙঝঞ

গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান আবারও প্রত্যাখ্যান করলেন নেতানিয়াহুঃ

            বিবিসি’র ও রয়টার্স-এর খবরে বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে আবারও সাময়িক যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, এ ধরণের কোনো উদ্যোগে তাঁর সায় নেই।

            গত রোববার পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।

বৈঠকে গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান আব্বাস। তবে মানবিক সহায়তা সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে কিছু বলেননি ব্লিঙ্কেনও।

            ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের লাগাম টানা নিয়ে এখনো বিপরীত মেরুতেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্ব। গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে আরব দেশগুলোও। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

“গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর না করলে যুক্তরাষ্ট্রকে কঠিন আঘাত করা হবে”

            অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা না করলে যুক্তরাষ্ট্রকে কঠিন আঘাত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ-রেজা আশতিয়ানি। গত রোববার তিনি এই হুমকি দিয়েছেন বলে ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম নিউজ এজেন্সির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

            এতে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে কঠিন আঘাতের মুখোমুখি হতে হবে যুক্তরাষ্ট্র। মোহাম্মদ-রেজা আশতিয়ানি বলেছেন, ‘‘আমেরিকানদের প্রতি আমাদের পরামর্শ: অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করুন, অন্যথায় কঠিন আঘাত করা হবে।’’

ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণঃ

            ফিলিস্তিন ভূমি মুসলমানদের কাছে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসের বেশ কিছু গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাপ্রবাহ। ইসলাম আগমনের আগে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে বসবাস করতেন তৎকালীন সময়ের আসমানী ধর্মের অনুসারীরা।

            হজরত ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা, দাউদ, সুলাইমান ও ঈসা আলাইহুমুস সালামের ধর্মের অনুসারীরা এই ভূমিতে বসববাস করতেন। এছাড়াও আরও অনেক নবীর আবাস্থল ছিলো ফিলিস্তিন।

            ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নগরীতে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মসজিদুল আকসার কথা তুলে ধরেছেন, এখান থেকেই সংঘটিত হয়েছিলো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মেরাজ।

            ইসলামের সূচনাকালে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করতেন মুসলিমরা। তাই মুসলমানদের প্রথম কেবলা বলেও পরিচিত পবিত্র এই মসজিদ। উমাইয়া, আইয়ূবী, সেলজুক, মামলুক, উসমানীওসহ বিভিন্ন মুসলিম শাসনামলে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিলো মুসলিমদের অধীনে।

            উল্লেখ্য, বায়তুল মুকাদ্দাসকে ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের সময় দখল করে নেয় ক্রুসেডাররা।  ক্রুসেডাররা মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পবিত্র আল কুদসের ভেতর ও বাহিরে মুসলিমদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

            ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে একে নাইটস টেম্পলারদের সদরদপ্তর করা হয়। সেসময় আল আকসা মসজিদকে রাজপ্রাসাদ ও পাশাপাশি ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তদুপরি, তৎকালীন সময়ের মুসলিম বীর সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ূবী ১১৮৭ সালের ২রা অক্টোবর শুক্রবার জেরুজালেম ও বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। যা ইসলামি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

            সম্প্রতি ফিলিস্তিনের আল আকসাকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান বলে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। পাসকৃত এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের ওপর ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই, আল আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান।

            প্রকাশ থাকে যে, আল–আকসা মসজিদ (ٱلْـمَـسْـجِـدالْاَقْـصَى) প্রতিবর্ণীকৃত: আল-মাসজিদ আল-আকসা, মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস হলো জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত ইসলামের ৩য় পবিত্রতম মসজিদ এবং এর সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আসসাখরা, কুব্বাত আসসিলসিলা ও আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলোসহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। এছাড়াও স্থানটি ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে পরিচত এবং ইহুদি ধর্মেও পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা:) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি উর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন।

            ইতিহাসবিদ পন্ডিত ইবনে তাহমিয়ার মতে, আসলে সুলায়মান-এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা। আর পবিত্র মসজিদের অবস্থান হলো এই ফিলিস্তিন।

            এখনে উল্লেখ্য যে, গত ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। জবাবে ওইদিন থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।

সূত্র: আল জাজিরা, টাইমস অব ইসরায়েল, আলজাজিরা, এএফপি, ব্লুমবার্গ, বিবিসি, নয়া  দিগন্ত, উঐঅকঅচঙঝঞ, ফাইনান্সিয়াল টাইমস ও রয়টার্স

Share This