
ইসলামী সংস্কৃতিতে ঈদের গুরুত্ব

\ ড. মো. মনিরুজ্জামান \
ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে ‘ঈদ’। ঈদ আরবী শব্দ, যার অর্থ বারংবার আসা, ফিরে আসা, স্মৃতিময় দিন, আনন্দ উদযাপন ইত্যাদি। মুসলিম জাতি পরস্পর মিলিত হয়ে যে আনন্দ উদযাপন করে থাকে তাই ঈদ। বছরে দু’টি ঈদ উদযাপিত হয়। প্রথমটি ঈদুল ফিতর তথা দীর্ঘ একমাস রামাদানের রোযা পালনের পরবর্তী দিবস। এ দিন মুসলিমগণ সূর্যোদয়ের পর সালাতুদ্দোহা আদায়ের সময় ঈদগাহে সমবেত হন এবং অতিরিক্ত ওয়াজিব ছয় তাকবীরসহ ঈদের দু’রাকাত সালাত আদায় করেন। প্রথম রাকাতে তিনটি এবং দ্বিতীয় রাকাতে অতিরিক্ত তিনটি করে তাকবীর বলা হয়। অনুরূপভাবে যিলহজ্জ মাসের দশম তারিখে উদযাপিত হয় ঈদুল আযহা তথা কুরবানীর ঈদ। এ ঈদেও অতিরিক্ত ওয়াজিব ছয় তাকবীর বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ) এর ত্যাগ ও তাঁরই তনয় ইসমাইল (আ) এর আনুগত্যের স্মৃতি রোমস্থন করতে মুসলিম উম্মাহর উপর কুরবানী ওয়াজিব করেছেন। দু’ঈদেই ঈদের সালাত আদায় করা মুসলমানদের জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, যা বর্জন করা গুণাহ।
রাসুল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় হিজরিতে ঈদ উদযাপিত হয়। আল্লাহ তায়ালা দ্বিতীয় হিজরিতে সিয়াম বা রোযা ফরয করেন। এ বছর রোযা সমাপ্ত হওয়ার পর ঈদুল ফিতর ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাসুল (সাঃ) এর ইমামতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ইসলামিক স্কলার ও বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী তালখীস গ্রন্থে এ অভিমত প্রকাশ করেন। মুবারকপুরীও এ মত সমর্থন করেন। ইবনে কাছীর বিদায়াহ ও নিহায়াহ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ঈদ হিসেবে ঈদুল আযহার কথা উল্লেখ করেন। ঈদ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য একটি আনন্দ উৎসব রয়েছে, আর এ হলো, আমাদের ঈদ।’ অপর হাদীসে তিনি বলেন- ‘হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) মদীনায় আগমনকালে মদীনাবাসী দু’টি দিনে খেলা করতো। তিনি মুসলমানরেকে বললেন, আল্লাহ সুবহানাহু তোমাদের জন্য সে দিনকে তদপেক্ষা উত্তম দু’টি দিন দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। ফিতর ও আযহা দিবস।’ এ দু’দিন মুসলিম উম্মাহ ঈদ উদযাপন করে আসছেন। ইসলাম মানুষের স্বভাব ধর্ম। মানব-স্বভাব গ্রহণ করতে চায় না বা স্বভাব বহন করতে অপারগ বা স্বভাবের সাথে যায় না এমন কোন বিধান ইসলাম আরোপ করেনি। মানুষের যেমন প্রকৃতি ও স্বভাব আছে তদ্রƒপ সমাজেরও স্বভাব প্রকৃতি আছে। এ দু’য়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে ইসলামী বিধান দিয়েছেন। এ জন্য ইসলামকে স্বভাব ও প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।
দীর্ঘ একমাস রোযা পালন শেষে মানুষের স্বভাবের চাওয়া হলো আনন্দ উপভোগ করা। একথা বিবেচনা করে আল্লাহর হাবীব (সা.) ঈদের ঘোষণা দেন। এ আনন্দ যেন আল্লাহর স্মরণমুক্ত না হয়, সে জন্য এদিন ঈদের সালাতের ব্যবস্থা রাখা হয়। আবার আনন্দের আতিশয্যে গা ভাসিয়ে দেয়ারও অবকাশ নেই। সমাজের সকল নাগরিক আর্থিকভাবে সমান সামর্থ্যবান হয়না। আনন্দের ভাগ যেন গরিব-দু:খী নির্বিশেষে সকলের গৃহেও পৌঁছে যায় সে জন্য প্রত্যেক রোযাদার ধনী ব্যক্তির উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। রামাদানের শেষ দিন সূর্যাস্তের পর হতে সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। ঈদগাহে গমনের পূর্বে তা আদায় করা সুন্নাত। তবে ঈদের এক বা দু’দিন পূর্বে আদায় করা জায়েয। ঈদের দিন আদায় না করা গেলে পরবর্তীতে আদায় করতে হবে। সদকায়ে ফিতর কি দ্বারা আদায় করা যাবে এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হলো, ছয় প্রকারের বস্তু ফিতরা হিসেবে দেয়ার সুযোগ আছে। যেমন হাদীসে এসেছে- ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন রাসুল (সাঃ) রামাদানে মানুষের উপর এক সা‘ খেজুর অথবা এক সা‘ জব বা ভুট্টা যাকাতুল ফিতর তথা সাদকায়ে ফিতর হিসেবে দান করা বাধ্যতামূলক করেছেন। যা মুসলমানদের মাঝে স্বাধীন, গোলাম, পুরুষ ও নারীর উপর আদায় করা বাধ্যতামূলক।’ সালাতুল ঈদ ও ফিতরা বিধান হতে প্রতিয়মান হয় যে, মুসলমান রঙ্গ-তামাশার মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করতে পারবেনা। বরং আনন্দেও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবে। এ দু’টি হাদীসের ভাষ্য মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, মুসলমানদের যে কোন উদযাপনে ইসলামে অনুমোদন নেই এমন কোন মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ নিষেধ। যেমন- পটকা ফোটানো, গান-বাজনা করা, যুবক-যুবতীর অবাধ মেলা-মেশা, মদ্যপান, জুয়ার আসর বসানো ইত্যাদি কার্যক্রম ইসলামে গর্হিত ও বর্জনীয় যা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। অভিভাবকদের মহানুভবতা ও মানবিক গুণাবলি দেখে পরিবারের ছোট-বড় সকল সদস্য শিক্ষা গ্রহণ করবে, যা নিজেদেরকে অনুরূপ কাজে অনুপ্রাণিত করে তুলবে ও মহান ও মানবিক হতে সাহায্য করবে। ঈদের বড় সার্থকতা হলো, মুসলিম মিল্লাত এদিনে হিংসা-বিদ্বেষ ভূলে পরস্পরের হিতাকাঙ্খী ও বন্ধু হয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির উৎকৃষ্ট উপায় ঈদের দিন সকলকে বুকে জড়িয়ে নেয়া। কর্মমর্দন করে ভালোবাসা ও ভালোলাগার কথা জানান দেয়া। ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন তৈরি করতে রাসুল (সাঃ) উম্মতকে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তাঁর বাণী-‘হযরত নু‘মান বিন বশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, মমতা ও সহমর্মিতার উদাহরণ হলো, তারা একটি দেহের মতো। যখন দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হয়ে যায় তখন সারা শরীরে বিনিদ্রা ও জ¦র চলে আসে।’ মোটকথা দয়া, সদ্ব্যবহার ও সহযোগিতার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের পরিচয় ফুটিয়ে তোলা যায়। কাজেই সর্বাবস্থায় মুসলমানের মাঝে এ তিনটি গুণাবলি থাকা বাঞ্চনীয়। কোন অবস্থায় নিঃস্ব, বিপদগ্রস্ত, হতাশা ও দুঃশ্চিন্তার মাঝে মুসলিম ভাইকে ছেড়ে যাওয়া মুসলিম চরিত্রের পরিপন্থি। যদি কোন কারণে দু’জন বা দু’দল মুসলমান ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়েও পড়ে তথাপি তাদের ছেড়ে যাওয়া যাবেনা; বরঞ্চ তাদের মাঝে মিমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রতিবেশী মুসলমানদের কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে ইরশাদ করেন- ‘মুমিনগণ একটি ভ্রাতৃসংঘ। সুতরাং তাদের মাঝে মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় যে, তোমারে প্রতি দয়া করা হবে।’ (হুজরাত) ই সংস্কৃতি মুসলমানদের মাঝে গভীর মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ ও সমাজসেবার চিন্তা-চেতনা জাগ্রত করে। অন্য কোন সংস্কৃতিতে ইসংস্কৃতির মত গভীর প্রভাব বিস্তারক উপাদান পরিলক্ষিত হয়না।
ঈদের দিন মুসলমান মুসলমানকে বিভিন্নভাবে অভিবাদন জানায়। যেমন আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) বলেন, তারা ইদগাহ থেকে ফেরার সময় পরস্পরকে বলতেন- ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা- আল্লাহ আমাদের ও তোমার পক্ষ হতে এ ইবাদত গ্রহণ করুন।’ বর্তমানে আরব বিশে^ অভিবাদনে বলা হয় ‘কুল্লু আম ওয়া আনতুম বি খায়ের- সারা বছর ভালো থাকবেন।’ আমরা বলে থাকি ‘ঈদ মোবারাক’। ভালোবাসা মিশ্রিত যে কোন অভিবাদনই ঈদের আনন্দকে বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়।
ঈদে সুন্দর পোষাক-আষাক পরিধান সম্পর্কে ইসলামে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সকল সালাত আদায়কালে সুন্দর পোষাক পরিধান করার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী- ‘হে বনী আদম! তোমরা প্রত্যেক সালাত আদায়কালে সৌন্দর্য প্রকাশক পোষাক পরিধান কর। আর খানাপিনা কর কিন্তু অপচয় করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালো বাসেন না।’ (আরাফ: ৩১) এ আয়াতে নফল ওয়াজিব ও ফরজ প্রত্যেক সালাতে শরীয়তসম্মত পোষাক পরিধানের আদেশ দেয়া হয়েছে। পোষাকে মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় সে কথাও বলা হয়েছে। যে পোশাকে সতর ঢাকা হয়না, যৌন সুড়সুড়ি বৃদ্ধি করে সে পোশাক পরিধানে বারণ রয়েছে। ঈদের সালাতে যাওয়ার সময় সুন্দর পোশাক পরিধান করা শরীয়ত অনুমোদিত। এমনকি ঈদ, জুমার জন্য বিশেষ পোষাকের ব্যবহারও শরীয়ত সম্মত। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন ‘রাসুল (সাঃ) ঈদের দিন একটি লাল চাদর পরিধান করতেন।’ হযরত নাফি‘ (র.) বলেন, ‘হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) ঈদের দিন জানাবাত তথা ফরজ গোসলের মত গোসল করতেন, সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং উত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ ঈদের দিন হেটে ইদগাহে যাওয়া সুন্নাত। হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইদগাহে হেটে যাওয়া এবং ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে কিছু খেয়ে যাওয়া সুন্নাত।’ গবেষকদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, হেটে যাওয়ার সময় সালাম দেয়া নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়, অসহায় মানুষদের খোঁজখবর নিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। সর্বোপরি রোড শো বা লক্ষ্যগতভাবে রাস্তায় বের হলে মুসলিমদের ঐক্যের নিদর্শন ফুটে ওঠে। শত্রæর অন্তরে ভয় জাগরিত হয়। এ সমাজে এখনও হতদরিদ্র এমন অনেক মানুষ আছে, যারা দিনে আনে দিনে খায়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক তার পক্ষে নতুন কাপড় জোগাড় করা, ঈদের সেমাই ক্রয় করা, সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ও আনন্দ করা সম্ভবপর হয়না। বিত্তবানের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সমাজের এ শ্রেণিটি কিছু সময়ের জন্য হলেও মনে করবে যে, আমি মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মত হিসেবে গর্বিত। তাঁর নির্দেশনা মোতাবেক মুসলিম ভাইয়েরা পরস্পরের বিপদে সাহায্য করছে। ঈদ নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধবনিতা, যুবক-যুবতী সকলের জন্য সমান। ঈদের সালাতে সকলের অংশগ্রহণের অনুমতি রয়েছে। সার্বজনীন এ ইবাদত প্রসঙ্গে হযরত উম্মে আতিয়্যার হাদিসটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) আমাদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনে ইদগাহে যাওয়ার আদেশ করেছেন। যুবতী, গৃহবাসিনী সকলের জন্য এ আদেশ। তবে ঋতু¯্রাবী সালাত আদায় করতে পারবেনা। তারা যে কোন উত্তম কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং মুসলমানদের দাওয়াতে যেতে পারবে। ইসলামী সংস্কৃতির এ পবিত্র ঈদ অশান্ত এ পৃথিবীতে শান্তি, ন্যায় বিচার, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টিতে যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে বর্তমানেও ঈদের আবেদন সুবিস্তৃত। অপসংস্কৃতির মোকাবেলায় ইসলামী সংস্কৃতির শিক্ষা ও অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতির সম্মুখে তুলে ধরা আবশ্যক। এবারের ঈদের আনন্দে ¯œাত হয়ে দূর হোক হিংসা, ঘনিভূত হোক প্রেম, ভালোবাসা, মনুষত্ব।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।