বুধবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ইসলামের দৃষ্টিতে পরোপকারের গুরুত্ব ও ফজিলত

ইসলামের দৃষ্টিতে পরোপকারের গুরুত্ব ও ফজিলত
Views

            ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ\ পার্থিব দুনিয়ায় মানুষ মানুষের সহযোগী। বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়াবে এমনটাই দাবি মানবতার। ইসলামে পরোপকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর মানবিকতা ও ঈমানের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে। পবিত্র কোরআনের এক আয়াতে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি জানো, বন্ধুর গিরিপথ কী? এটা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার দেয়া এতিম আত্মীয়কে বা দারিদ্র্য-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে। এর পরই সে হবে ঈমানদারের অন্তর্ভুক্ত…। (সুরা : বালাদ, আয়াত : ১২-১৭)।

            পরোপকারের পার্থিব প্রতিদানস্বরূপ সৌভাগ্যময় মৃত্যু হয় এবং মন্দ মৃত্যু থেকে সুরক্ষা মেলে। উম্মে সালামা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, সৎ কাজ করার ফলে মন্দ মৃত্যু থেকে সুরক্ষা মেলে; গোপনে কৃত দান রবের ক্রোধ নিভিয়ে দেয় এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় আয়ু বৃদ্ধি পায়। (সহিহুত তারগিব, হাদিস : ৮৯০)। মহান আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে সুযোগ-সুবিধা এবং অভাব পূরণের ক্ষমতার মতো নিয়ামত দান করেন। অতঃপর যখন সে ওই নিয়ামত প্রাপ্ত হয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালন না করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার থেকে সেসব নিয়ামত উঠিয়ে নেন।

            আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর জন্য নিবেদিত এমন অনেক বান্দা আছে যাদেরকে আল্লাহ তাআলা মানুষের উপকার করার জন্য বিশেষ নিয়ামত দান করেন। যতণ তারা সেগুলো মানবকল্যাণে ব্যয় করে ততণ তিনি তাদের সেসব নিয়ামতের মধ্যে বিদ্যমান রাখেন। কিন্তু যখন তারা সে উপকার করা বন্ধ করে দেয়, তখন তিনি তাদের থেকে নিয়ামত ছিনিয়ে নিয়ে অন্যদের দিয়ে দেন। (সহিহুত তারগিব, হাদিস : ২৬১৭)।

            আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে যাবে না।

            যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিনে তার কষ্টগুলো থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (বুখারি, হাদিস : ২৪৪২)।

            আল্লাহ তাআলা মানুষের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা যার হাতে দিয়েছেন অথবা যার নেতৃত্বে কিংবা যার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন পূরণ হতে পারে, সে যদি তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দাকে কোনো নিয়ামত পরিপূর্ণরূপে দান করেন এবং তারপর লোকদের প্রয়োজন তার দিকে যোগ করে দেন, কিন্তু সে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার এমন আচরণের ফলে সে ওই নিয়ামত হাতছাড়ার ব্যবস্থা করে। (তাবারানি, আওসাত, হাদিস : ৭৫২৯; সহিহুত তারগিব, হাদিস : ২৬১৮)।

            রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদিসে পরোপকারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। এখানে পরোপকারের ফজিলত সম্পর্কিত ৪টি হাদিস তুলে ধরা হলো : আল্লাহর দয়া। পরোপকার সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৪৭)।

            যে মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ। অপর হাদিসে মহানবী সা. বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই পরোপকারের চেতনায় কোনো শ্রেণিভেদ নেই। বড়-ছোট, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বজাতি-বিজাতি, মুসলিম-অমুসলিম এসব ব্যবধানের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামের শান্তি ও সৌহার্দ্যের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭)।

            কারো অভাব দূর করলে আল্লাহ স্বাচ্ছন্দ্য দান করেন। আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখিরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)।

সাহাবিদের দানের প্রতিযোগিতা : পরোপকারের জন্য সাহাবিরা একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেন। এক হাদিসে জায়দ ইবনে আসলাম রহ. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : উমর রা.-কে আমি বলতে শুনেছি, রাসূল সা. (তাবুকের যুদ্ধের সময়) আমাদেরকে দান-সদকা করার নির্দেশ দেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় আমার সম্পদও ছিল। আমি (মনে মনে) বললাম, যদি আমি কোন দিন আবু বকর রা.-কে অতিক্রম করে যেতে পারি, তাহলে আজই সেই সুযোগ। উমর রা. বলেন, আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসলাম। রাসুল সা. বললেন, তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি রেখে এসেছ? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ। আর আবু বকর রা. তাঁর পুরো সম্পদ নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, হে আবু বকর! তোমার পরিবার-পরিজনদের জন্য তুমি কি রেখে এসেছ? তিনি বললেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলকেই রেখে এসেছি। আমি (মনে মনে) বললাম, আমি কখনও আবু বাকর (রা.)-কে অতিক্রম করতে পারব না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৬৭৫)।

            পরিশেষে বলতে চাই, সুন্দর এ বসুন্ধরায় মানুষের জীবন কতই না বিচিত্র। সমাজ-সভ্যতা, জাতি-গোষ্ঠি, সাদা-কালো মূর্খ জ্ঞানী ইত্যাদি প্রকার প্রকারণে মানুষের মন মানসিকতা ও আচার-আচরণ আরও বৈচিত্র্যের। এ বৈচিত্র্যের নতুন সমন্বয় ঘটে বিশ্বাস নামক এক শক্তি। এ বিশ্বাস ও শক্তি মানুষের মাঝে অনাগত দিনের আশার আলো সঞ্চয় করে এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। পৃথিবীর বুকে মানুষের সংখ্যা দিন-দিন যতই বাড়ছে মানুষে- মানুষে বিভেদ ও ভিন্নত রোগ-ব্যাধি দারিদ্র বঞ্চনাসহ নানা সমস্যা ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব ভিন্নতর প্রকার ও প্রকরণের সমস্যার অবসানে প্রয়োজন আমাদের চারিত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। সব মানুষ এক হয়ে আর্তমানবতার সেবায় একই সূত্রে গাথা হোক এটা আজকের সমাজ জীবনে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একথা একেবারেই ভুলে গেছি।

            আজ প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে ঘাত-প্রতিঘাত, হিংসা অহংকার, রাজনৈতিক কলহ, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি হিংসাত্মক ঘটনা সমাজে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। এ কারণে দেশবাসী আজ শংকিত বিপন্ন মানবতা, বঞ্চিত অধিকার, লাঞ্চিত বিবেক সমাজে রুটিনে পরিণত হয়েছে। আসলে সব সৃষ্টিই আল্লাহপাকের, সৃষ্টির ও বিশাল পরিবেশ আল্লাহর রহমতের সেতুবন্ধন এবং পরিবারস্বরূপ। আল্লাহ একটি অন্যটির প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন। তাই আসুন আমরা সকলেই পরোপকারী হই। অপরের বিপদে তার পাশে দাঁড়াই। অন্যের প্রয়োজনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করি। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে পরোপকার করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Share This

COMMENTS