বৃহস্পতিবার, ১৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কানাডা মানেই ফ্রি কান্ট্রি; পা রাখলেই টের পাওয়া যাবে!

কানাডা মানেই ফ্রি কান্ট্রি; পা রাখলেই টের পাওয়া যাবে!
Views

            নজরুল মিন্টু\ একসময় ভাবতাম, কানাডা মানেই ‘ফ্রি কান্ট্রি’। এখানে মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে- ইচ্ছে হলে রাস্তায় গান গাইবে, পার্কে ঘুমাবে, গাড়ির মধ্যে বসেই মদ খাবে। রাষ্ট্র কিছু বলবে না, আইন-আদালত মাথা ঘামাবে না। কিন্তু কানাডায় পা রাখতেই টের পেলাম, এই ‘ফ্রি’র অর্থ আসলে পুরোপুরি ভিন্ন। এখানে স্বাধীনতার চারপাশে গাঁথা রয়েছে জটিল নিয়ম-কানুনের এক ঘন জাল। আর সেই জালের ফাঁক দিয়েই কখনো কখনো উঁকি দেয় এমন কিছু গল্প, যেগুলো একদিকে যেমন শিক্ষণীয়, তেমনি অন্যদিকে হাস্যরসের অনন্য দৃষ্টান্ত।

            কানাডা (ইংরেজি: ঈধহধফধ) উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। এর দশটি প্রদেশ ও তিনটি অঞ্চল আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।

            এই দেশ এমন এক জায়গা, যেখানে আপনি যখন-তখন যেখানে খুশি সেখানেই বসে মদ খেতে পারবেন না। রাস্তা, পার্ক, সৈকত, এমনকি নিজের গাড়ির ভেতরেও জনসমক্ষে মদ্যপান আইনত নিষিদ্ধ! যদি মদ্যপান করতে চান, তাহলে নির্ধারিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার বা রেস্টুরেন্টে যেতে হবে।

            তদুপরি, ইচ্ছে হলেই যেকোনো রেস্টুরেন্ট বারে রূপান্তর করাও এত সহজ নয়। এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের মতামত নিয়ে তবেই মদ বিক্রির লাইসেন্স দেয়া হয়। নিয়ম অমান্য করলেই লাইসেন্স বাতিল, জেল-জরিমানাও হতে পারে! রাত ২টার পর বারগুলোতেও মদ সরবরাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মদ বা লিকারের ব্যবসা পুরোপুরি সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত। এখানে ‘স্বাধীনতা’র আর এক নাম-লাইসেন্স।

            ধূমপান নিয়েও একইরকম কঠোরতা। পার্ক, অফিস, রেস্টুরেন্ট এমনকি খোলা মাঠেও ধূমপান নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে গুনতে হবে এক হাজার ডলারেরও বেশি জরিমানা। পিকনিকে গিয়ে উচ্ছিষ্ট ফেললেও জরিমানার মুখে পড়তে হয়। এতটাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই দেশ যে, এখানে অসচেতন হওয়ার কোনো জায়গা নেই।

            কানাডায় ‘আইন সকলের জন্য সমান’-এই কথাটি কোনো রাজনৈতিক ¯েøাগান নয়; বাস্তবেই তা ঘটতে দেখা যায়। যেমন, একবার টরন্টোর সাবেক মেয়র মেল লাস্টমেন নিজের গাড়ি একটি ‘নো পার্কিং’ স্থানে পার্ক করে রেখেছিলেন। গাড়ির নম্বরপ্লেট ছিল ‘গধুড়ৎ ১’। মেয়রের গাড়ি জেনেও পুলিশ বিন্দুমাত্র দমে যায়নি- বরং গাড়িটিকে সঙ্গে সঙ্গেই টো করে মানে তুলে নিয়ে গেছে।

            ঠিক তেমনই, একবার এক পুলিশ অফিসার নিজের গাড়িটি ফুটপাথে রেখে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় ঐ এলাকায় ডিউটিরত আরেক পুলিশ অফিসার এসে তাঁর গাড়িতে টিকেট দিয়ে দেন। পরদিন পত্রিকায় ছবিসহ এই সংবাদ প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ মনে করলো, “এই দেশ সত্যিই অন্যরকম- এখানে শাসক আর শাসিতের মাঝখানে আইনের একটা সেতুবন্ধন রয়েছে, যেটা কেবল বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না; বরং বাস্তবেও কাজ করে।”

            এ ধরনের ঘটনার শেষ নেই কানাডায়। কিছুদিন আগে এক মন্ত্রী বিদেশ থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দরের কাস্টমস অফিসাররা যখন তাকে চেনা সত্তে¡ও তল্লাশি করছিলেন, তখন তিনি কটারে সুরে বলেছিলেন, “ভালো করে চেক করো, কিছু পেলে পেতে পারো!”

            কথাটি অপমানজনক মনে হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অফিসার তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অভিযোগ করেন। মন্ত্রী যখন বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন রেডিওতে খবর পান- তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি অন-ডিউটি একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিলেন।

            আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা হলো: এক এমপি এবং এক ‘জনপদবধূ’কে নিয়ে! সরকারি দলের একজন স্থানীয় এমপি রাস্তায় দাঁড়ানো এক নারীকে নিজের গাড়িতে তুলে নেন। তিনি জানতেন না, সেই নারী আসলে ছদ্মবেশী মহিলা পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রেফতার হন সেই এমপি। এই ঘটনাও ব্যাপক হাস্যরস সৃষ্টি করেছিল কানাডার মিডিয়া জগতে।

            মূলতঃ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে কানাডায় পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রাহক খোঁজা, বিজ্ঞাপন দেয়া বা যৌনকর্মীর সঙ্গে প্রকাশ্যে লেনদেন করাটা সম্পূর্ণ বেআইনি। প্রায়ই মহিলা পুলিশ সদস্যরা ছদ্মবেশে যৌনকর্মী সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করেন।

            আরেকটি ঘটনা হলো: অনেকের কাছে ঘটনাটি হালকা মনে হলেও বিষয়টি গম্ভীর এবং পুরোপুরি আইনানুগ। একবার এক গাড়িচালক এক সাইকেল চালককে সিগন্যাল ছাড়াই হর্ণ দিয়ে ওভারটেক করেন। সাইকেল চালক পুলিশকে ফোন করে জানালেন, তিনি ‘আতঙ্কিত’ হয়েছেন। পুলিশ এসে গাড়িচালককে জরিমানা করে এবং টিকিটে লেখেঃ ‘টহহবপবংংধৎু যড়ৎহ ফরংঃঁৎনরহম পুপষরংঃ’ং সবহঃধষ ঢ়বধপব.’

 কানাডার আইন এমনই যে, বাড়ির মালিকরাও ভাড়াটিয়ার অনুমতি ছাড়া বাড়ি দেখতে আসতে পারেন না। অনুমতি না নিয়ে দরজা খুলে ঢুকে পড়লে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ হিসেবে গণ্য হয়, তার বিরুদ্ধে জরিমানা থেকে শুরু করে মামলাও হতে পারে। ভাড়া না দিলে ঝগড়া-বিবাদ বা গালাগালি করাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সমস্যার সমাধানে যেতে হবে আদালতে। এখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা বর্ণ নিয়ে সামান্য বৈষম্যমূলক আচরণও সহ্য করা হয় না। সরকারি কর্মকর্তা এমন কিছু করলে চাকরিতো যাবেই, সঙ্গে জেল-জরিমানাও নিশ্চিত।

            এছাড়া, যেখানে সেখানে ‘এফ’ ওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না। এটার জন্যও জরিমানা আছে। কোন্ শব্দ আপনি প্রকাশ্যে ব্যবহার করতে পারেন, সেটাও আইন নির্ধারণ করে দিয়েছে।

            ‘ফ্রি কান্ট্রি কানাডা’- এই বাক্যটি শুনলে আমাদের চোখে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, বাস্তবে তা অনেক বেশি সুবিন্যস্ত, সংযত এবং সুশৃঙ্খলিত। এখানে স্বাধীনতা আছে ঠিকই, তবে তা কেবলমাত্র দায়িত্ব ও নিয়মের সীমানার মধ্যে। এই শৃঙ্খলা কখনো কখনো কঠোর মনে হলেও, সেটিই কানাডাকে গড়ে তুলেছে নিরাপদ, সমানাধিকারভিত্তিক ও সম্মানজনক একটি রাষ্ট্রে। এই দেশ শেখায়- আইন মানা একধরনের সামাজিক শিল্প। আর সেখানেই কানাডার সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববোধ। এইজন্যই কানাডা শুধু ‘ফ্রি কান্ট্র্রি’ নয়; বরং একটি সচেতনতার পাঠশালা- যেখানে স্বাধীনতা মানে দায়বদ্ধতা অবশ্যম্ভাবী।

Share This

COMMENTS