বুধবার, ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কুমিল্লা অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ মাসে ঝরেছে ৫২৫ প্রাণ

কুমিল্লা অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনায়  ৯ মাসে ঝরেছে ৫২৫ প্রাণ
Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ হাইওয়ে কুমিল্লা অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে অন্তত তিনটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২ জন প্রাণ হারান, আর আহত হন অন্তত ৫ জন; যা বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

            ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা-নোয়াখালী, কুমিল্লা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৭৯২ কিলোমিটার সড়কে চলতি বছরের ৯ মাসে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

            চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা রিজিয়নের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৮৪২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫২৫ জন; আর ১ হাজার ২১০ জন আহত হয়েছেন বলে জানান কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার শাহীনূর আলম খান।

            এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেইট পর্যন্ত মহাসড়কে ৪৬৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২৮৪ জনের; আর আহত হয়েছেন ৫০৯ জন।

            হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে কুমিল্লা রিজিয়নে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৪ সালে এই অঞ্চলটিতে সড়ক দুর্ঘটনা সংখ্যা ছিল ৬৩০টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫২২ জন। আর আহত ৭৮৪ জন। চলতি বছর দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার বিগত বছরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

            বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ কুমিল্লা কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, ৪০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনা অতিরিক্ত গতির জন্য হয়ে থাকে। গতি নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করলেও অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে বিআরটিএ কিংবা পুলিশ কেউই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে না।

            সংবাদকর্মী আব্দুল­াহ আল মারুফ বলেন, গত বছরের ৫ই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে মহাসড়কে পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ বিগত বছরের তুলনায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। হাইওয়ে পুলিশ সক্রিয় থাকলে যানবাহনে অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং লাইসেন্সবিহীন চালকদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব।

            এ বিষয়ে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব এড়াতে পারে না, তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব বলে মনে করেন এই সংবাদকর্মী।

            আব্দুল্লাহ আল মারুফ বলেন, “এক বছর ধরে মহাসড়ক ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে খানাখন্দ এবং ভাঙাচোরায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। যে কারণে যানবাহন নষ্ট হবার পাশাপাশি, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে।”

            বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ বলেন, বৈধ গাড়ির চেয়ে অন্তত ২০ গুণ রয়েছে অবৈধ গাড়ি। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যা নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে বৈধ ও অবৈধ গাড়ির মধ্যে।

            এ ছাড়া অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মহাসড়কে থ্রি হুইলার, অবৈধ স্থাপনা ও বাজার এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করেন এ পরিবহন নেতা।

            লাইসেন্সবিহীন চালক প্রসঙ্গে কবির আহমেদ বলেন, “দেশে মোট ৬২ লাখ যান্ত্রিক যানবাহন বিআরটিএতে রেজিস্ট্রেশন করা আছে। ৬২ লাখের মধ্যে ৪৬ লাখই মোটরসাইকেল। বাকিগুলো বাস, ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহন।

            “বিআরটিএ এ যাবৎ ডেলিভারি দিয়েছে ২৯ লাখ লাইসেন্স; বাকি ৩৩ লাখ গাড়ি চলাচল করে লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে। বিআরটিএ-এর কাছে পরিবহনের সংখ্যা নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য আছে কি-না তাও জানা নেই। কারণ এ পথে কি পরিমাণ যানবাহন চলবে সেটি কখনোই নির্ধারিত হয়নি।”

            যানবাহনের নিরাপত্তা ও গতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আড়াইশ কিলোমিটার জুড়ে প্রায় দেড় হাজার সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তবে সব ক্যামেরা থেকে এখনো তথ্য নিতে পারছে না হাইওয়ে পুলিশ।

            কিছু কিছু এলাকা থেকে অতিরিক্ত গতির যানবাহন শনাক্ত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার কথা বলছে হাইওয়ে পুলিশ। তবে পুরো সড়কে যেসব ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, সেগুলো থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেলে মহাসড়ক আরও বেশি নিরাপদ হবে বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

            কুমিল্লা হাইওয়ে অঞ্চলের পুলিশ সুপার শাহীনূর আলম খান বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তায় স্থাপন করা সিসি ক্যামেরাগুলোর দায়িত্ব এখনো হাইওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। আশা করছি শীঘ্রই তা পুলিশের কাছে আসবে।

            “যেসব ক্যামেরা চালু রয়েছে, সেগুলো মেঘনা ঘাটে একটি কন্ট্রোল রুম থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। ৫ই আগস্টের আন্দোলনে কিছু ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আশা করি সেগুলো খুব দ্রæত মেরামত করা হবে।”

            অবৈধ থ্রি হুইলার প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার শাহীনূর আলম বলেন, “মহাসড়কে গণপরিবহন না বাড়ানো হলে থ্রি হুইলার একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এখানে অনেক মানুষের জীবিকা জড়িত। তবে আমরা চেষ্টা করছি, তারা যেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে মহাসড়কে প্রবেশ করতে না পারে।”

            হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ৬২ কিলোমিটারে। খানাখন্দ আর ভাঙ্গাচোরায় বেহাল অবস্থা এই সড়কের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন আঞ্চলিক সড়কগুলোও অবস্থা বেহাল।

            কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সুগন্ধা পরিবহনের চালক আবুল হাসান বলেন, “মহাসড়কে এমন কোনো দিন নেই যে দুর্ঘটনা ঘটে না। শুধুমাত্র সড়কের বেহাল অবস্থার কারণেই এই দুর্ঘটনা বাড়ছে প্রতিদিন।

            “সরু এবং ভাঙাচোরা সড়ক হওয়ায় ভারি যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনের সঙ্গে ছোট ছোট যানবাহনের সংঘর্ষে প্রায়ই প্রাণহানি এবং অঙ্গ হানির ঘটনা ঘটছে।

            কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আদনান ইবনে আলম বলেন, “বিগত বছরের বন্যা এবং চলতি বছরের প্রবল বর্ষণে কুমিল্লাতে দেড়শ কিলোমিটার সড়ক বিধ্বস্ত হয়েছে। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মধ্যে সব ভাঙা সড়ক মেরামত শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।”

Share This

COMMENTS