কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য


মুহাঃ জাকির হোসাইন
মানব সভ্যতার সূচনা লগ্নে সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরূপনে কুরবানীর সূত্রপাত ঘটে। কুরবানী মুসলিম সংস্কৃতি ও তামুদ্ধনিক বিষয়। যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং ভ্রাতৃত্বের সুদূঢ় বন্ধন রচিত হয়। আলোচ্য নিবন্ধে কুরবানির ইতিবৃত্ত ও তাৎপর্য সংপ্তি পরিসরে আলোকপাতের প্রয়াস রাখছি।
কুরবানী বলতে যা বুঝায়: কুরবানী আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ উৎসর্গ করা, নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। কুরবানীর সমার্থবোধক হচ্ছে নহর। ইংরেজিতে বলা হয়, ঝধপৎরভরপব, উবফরপধঃব. পরিভাষায় ১০ই জিলহ্জ্জ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম জাতি হালাল পশু উৎসর্গ করাকে কুরবানী বলে। শব্দের অর্থ হলো; আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন জিনিস উৎসর্গ করা। কুরআনুল কারীমের একাধিক স্থানে কুরবানী শব্দটি উক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুরা কাউছারের ২ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- “অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত (নামাজ) আদায় করুন এবং কুরবানি করুন।” (১০৮:২)
এছাড়া ও সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াতে এবং সুরা আহকাফ এর ২৮ নং আয়াতে উক্ত অর্থে কুরবানী শব্দটি উল্লেখ রয়েছে।
কুরবানীর ইতিহাস; কুরবানী আদম (আ:) থেকে আরম্ভ করে অদ্যাবধি ধারা অব্যহত রয়েছে। তবে মানবতা ও মুসলিম ইতিহাসে কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
১. আদম (আ:) এর সময়ে কুরবানী: কুরবানী আদি পিতা ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ:) এর সময় থেকেই উদ্ভব ঘটে। হযরত আদম (আ:) দুই পুত্র সন্তান হাবিল ও কাবিল এর মাঝে কোন একটি বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে উভয়েই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনায় আদম (আ:) এর আদেশে হক বাতিল নির্ণয়ের লক্ষ্যে কুরবানী পেশ করেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
“আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজন থেকে গ্রহণ করা হল, আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হল না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন’।” (সূরা মায়েদা-৫:২৭)
উক্ত আয়াতের তাফসীরে মুফাসিরীনগন লিখেছেন; আদম আলাইহিস সালামের দুই সন্তান হাবিল ও কাবীল তাদের বোন আকলিমাকে বিবাহ করার নিমিত্বে দ›েদ্ব লিপ্ত হয়। তাদের দ্ব›দ্ব নিরসনে পিতা আদম (আ:) এর নির্দেশনায় কুরবানির জন্য সিদ্ধান্ত নেয় । হাবিল একটি সুষ্ঠ সবল দুম্বা কুরবানী করল আর কাবিল যেহেতু শস্য উৎপাদন করত তাই সে তার উৎপাদিত ফসল থেকে কিছু অংশ কোরবানির উদ্দেশ্যে পেশ করেছিল।
হাবিলের কুরবানী আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হয়েছিল তাই আলামত হিসাবে আসমানী আগুন এসে ভষ্ম করে দিয়েছিল । কিন্তু কাবিলের কুরবানী কবুল না হওয়ায় তা তার আপনস্থানেই পড়ে ছিল । এ বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন- “যখন তারা উভয়েই কুরবানী পেশ করল তখন আল্লাহ তাআলা তাদের একজনের কুরবানী কবুল করলেন, অন্যজনের কুরবানী কবুল করা হলো না। আর আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র মুত্তাকিনদের থেকেই কবুল করেন।”
(সূরা মায়েদা আয়াত নং ২৭)
২. হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে কুরবানীর দাওয়াত পৌঁছে দিলেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানীর বর্ণনা এভাবে এসেছে-
“অতঃপর সে পুত্র (ইসমাইল আলাইহিস সালাম) যখন পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন সে বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করেছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী ? পুত্র বলল হে আমার পিতা ! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ্, আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (তা ছিল এক বিষ্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে (জবেহ করার উদ্দেশ্যে) শুইয়ে দিলেন, আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম; হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিলো এক স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে সে শিশুকে মুক্ত করলাম।” (সূরা আস-সাফফাত-৩৭: ১০২-১০৭)
(পিতা-পুত্র উভয়ে তো নিজেদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন প্রসঙ্গে এটাই ধরে নিয়েছিলেন যে, পিতা পুত্রকে যবেহ করবেন। তাই হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে যবেহ করার উদ্দেশ্যে কাত করে জমিনে শোয়ালেন। পিতা পুত্র উভয়ে যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালার আদেশ পালনের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী সব কিছুই করে ফেলেছিলেন, তাই তারা উক্ত পরীক্ষায় পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছেন অনন্তর আল্লাহ তা’আলা তাঁর কুদরতের এক কারিশমা দেখালেন। ছুরি হযরত ইসমাইল (আ:) এর গলায় না চলে তার স্থলে একটি দুম্বার গলায় চলল। আল্লাহ তাআলা সেটিকে নিজ কুদরতে সেখানে পাঠিয়ে দেন। আর হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে জীবিত ও নিরাপদ রাখলেন।)
হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর কুরবানি:
৩. হযরত মোহাম্মদ (সা:) ও পরবর্তী মুসলিম জাতির কুরবানী: কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সমর্থবান নর-নারীর উপর কুরবানী ওয়াজিব। এটি মৌলিক ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তে মুহাম্মাদির কোরবানী মিল্লাতে ইব্রাহীমীর সুন্নাত । সেখান থেকেই এসেছে এই কুরবানী। এটি ইসলামের শিয়ার বা ইসলামের প্রতীকি বিধানাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা পালনে ইসলামি প্রতীকের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এছাড়া ও এই কুরবানির মাধ্যমে গরীব-দুঃখী, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কুরবানিতে । পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার জন্য ত্যাগের শিক্ষাও আছে এতে।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন; অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্য নামাজ পড়–ন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার ০২)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন; জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদের দিন দু’টি মেষ যবেহ করেন। তিনি পশু দু’টিকে কিবলামুখী করে বলেন; “ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল-আরদা হানীফাঁও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াকা ও মামাতী লিল্লাহি রব্বিল আলামীন। লা শারীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা আওওয়ালুল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা আন মুহাম্মাদিন ওয়া উম্মাতিহি।” অর্থ্যাৎ- “আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই” (সূরা আনআমঃ ৭৯)। অপর আয়াতে এসেছে- “বলো, আমার নামায, আমার ইবাদত (কুরবানী), আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নাই এবং আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম” সূরা আনআমঃ ১৬২-৩)
অত:পর রাসুল (সা:) বলেন, “হে আল্লাহ! তোমার নিকট থেকেই প্রাপ্ত এবং তোমার জন্যই উৎসর্গিত। অতএব তা মুহাম্মাদ ও তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে কবুল করো”। (তিরমিযী ১৫২১, আবূ দাউদ ২৭৯৫, ২৮১০, আহমাদ ১৪৪২৩, ১৪৪৭৭, ১৪৬০৪, সুনানে দারেমী ১৯৪৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২১)
আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি উক্ত বিধান কে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নাত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং নিজের জীবদ্দশায় আমলের মাধ্যমে এবং সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী উম্মতকে উক্ত বিধান পালন করতে আদেশ দিয়েছেন। ফলে তা পৃথিবীর এক অবিচ্ছেদ্য বিধান হিসাবে স্বীকৃত হয়ে থাকল ।
হাদিসে এসেছে, যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই কোরবানী কী? তিনি বলেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ:) এর সুন্নাত (ঐতিহ্য)। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! এতে আমাদের জন্য কী (সওয়াব) রয়েছে? তিনি বলেন, প্রতিটি পশমের পরিবর্তে পুণ্য হবে (এদের পশম তো অনেক বেশি)? তিনি বলেন, লোমশ পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকী রয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৭, সুনানে তিরমিযী হাদিস নং ১৪৯৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৬)
কুরবানির গোশত খাওয়া প্রসঙ্গ:
একটি বিষয় পাঠকগণ হয়তো খেয়াল করছেন যে, কুরবানীর মূল বিষয় (অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করা) প্রাগৈতিহাসিক ভাবে চলে আসছে। তবে তা আদায়ের পদ্ধতি ভিন্ন। *অন্যান্য নবীরে উম্মত থেকে উম্মতে মুহাম্মদির কুরবানীর আরো বড় একটি পার্থক্য হলো; অন্যান্য উম্মত কুরবানীকৃত পশুর গোশত নিজেরা বা অন্য কোন মানুষে খাওয়ার বিধান জায়েজ ছিল না বরং কুরবানি করে কোন জায়গায় রেখে আসত অতঃপর যে কুরবানি কবুল হতো তাকে আসমানী অগ্নি এসে ভষ্ম করে দিয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা:) এর উছিলায় এই উম্মতের জন্য সে বিধান রাখেন নি। বরং এই উম্মতের জন্য কুরবানীর পশুর গোশত খাওয়া বৈধ করেছেন। এমনকি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবানে উক্ত গোশত খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে ইরশাদ করেন-
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোরবানী দেয় সেও যেন তার কোরবানি থেকে খায়। (মাজমায়ুুজ জাওয়ায়েদ হাদিস নং ৫৯৯০, ৫৯৯১)
উল্লেখ্য যে, কুরবানির গোশত কুরবানি দাতা, গরিব-মিসকিন এবং আত্মীয়স্বজনদের বিতরণ ও খাওয়ানো উত্তম। নির্দিষ্ট অংশ দুস্থ কিংবা আত্মীয় স্বজনকে দেয়া আবশ্যক না হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দান করা এবং আতিথেয়তার উত্তম সুযোগ হিসেবে আমরা কুরবানির সময় উল্লেখিত লোকদের আতিথেয়তা এবং গোশত বণ্টন করা একান্ত প্রয়োজন। আর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে চাইলে ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু বিক্রি করলে তা গরিব-মিসকিনের হক হয়ে যাবে।
কুরবানীর উদ্দেশ্য;
যেহেতু সম্পদ মূলত: আল্লাহর-ই দান বা অনুগ্রহ। তাই তিনি কোন বিধান আরোপ করলে স্বাচ্ছন্দচিত্তে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে উক্ত বিধান ইবাদত হিসেবে পালন করা মুমিন-মুসলিমের দায়িত্ব। আর কুরবানী এমন একটি ইবাদত তার সকল উপকারিতা বান্দা ভোগ করে, আল্লাহ তাআলা শুধু মাত্র বান্দার তাকওয়া দেখেন । পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
“আল্লাহর কাছে ওগুলোর না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।”
(সূরা হাজ্ব-৭৮:৩৭)
কুরবানি দাতার উদ্দেশ্য: কুরবানি দাতার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থে কিংবা নিজের পালিত কুরবানির জন্য প্রযোজ্য পশু দ্বারা নির্দিষ্ট তারিখ (১০ই জিলহজ্জ) কুরবানি করা। লৌকিকতা ও অহংকার বর্জনীয়। আল্লাহ তায়ালার তাঁর নবী ও উম্মতকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বলেন-
“(হে রাসূল আপনি বলেন), আমার নামাজ আমার কুরবানী, আমার জীবন আমার মরন (অর্থাৎ আমার সবকিছু ই রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত।” (সূরা আনআম-৬:১৬২)
উল্লেখ্য যে, আমরা কুরবানির দিন যে পরিমাণ অর্থ ব্যায়ে কুরবানি করি এবং গোশত গ্রহণ করি সাধারণত অন্য সময়ে সে পরিমাণ গোশত কিংবা অর্থ ব্যয় করি না। তাহলে কেন আমরা কুরবানির গোশত সংরক্ষিত করে কেবল নিজেরা ভক্ষন করবো। তা কখনো কাম্য নয়। আমাদের দেশে প্রায়শঃ দেখা যায় অধিকাংশ কুরবানি দাতা সামান্য পরিমাণ গোশত গরিব দুঃখি এবং পাড়া প্রতিবেশিকে দিয়ে অধিকাংশই ফ্রিজে সংরক্ষণ করে তা পরবর্তীতে নিজেরা খাই। এটা যদিও হারাম নয়, তবে তা কুরবানির উদ্দেশ্যের সাথে মিল নেই। যারা গোশত খাওয়া কিংবা লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কুরবানি দেয় পরকালে তা তাদের কোনো উপকারে আসার সম্ভাবনা নেই। যাকে আমরা বলতে পারি ইধংবষবংং নঁংশবঃ- অর্থাৎ তলা বিহীন ঝুড়ি।
কুরবানির গুরুত্ব ও ফজিলতঃ
কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত কুরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। হাদিসে এসেছে- “আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কুরবানির দিন আদম সন্তান এমন কোন কাজ করতে পারে না, যা মহামহিম আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত (কুরবানি) করার তুলনায় অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। কুরবানির পশুগুলো কিয়ামতের দিন এদের শিং, খুর ও পশমসহ উপস্থিত হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই (কুরবানি) মহান আল্লাহর নিকট সম্মানের স্থানে পৌছে যায়। অতএব তোমরা স্বাচ্ছন্দচিত্তে কুরবানি করো।”
অপর হাদীসে এসেছে; হযরত যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এই কুরবানী কী? তিনি বলেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ:) এর সুন্নাত (রীতি)। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! এতে আমাদের জন্য কী (উপকার) রয়েছে? তিনি বলেন, “প্রতিটি পশমের পরিবর্তে পুণ্য হবে। তাঁরা আশ্চার্যান্বিত হয়ে বলেন, “পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে! তিনি বলেন, পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সাওয়াব দেয়া হবে।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৭, সুনানে তিরমিযী হাদিস নং ১৪৯৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৬)
এসকল ফজিলত থাকার পরেও যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্বেও কুরবানী করবে না, একে গুরুত্ব না দেওয়ার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর ভাষায় ইরশাদ করেছেন; “আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন; যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও যেন না আসে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৩)
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত হাদিসে মূলত সম ব্যক্তি কুরবানি না দিলে তাকে ঈদগাহে যাওয়া থেকে নিষেধ করা উদ্দেশ্য নয় বরং তাকে এর গুরুত্ব ও বর্জনের ভয়াবহতা বোঝানো উদ্দেশ্য।
পরিশেষে বলা যায়, বৈধ উপার্জনে অর্জিত সম্পদে কুরবানি তথা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে, এটাই ইমানের দাবি। কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনায় দু:স্থ মানবতা ও আত্মীয় স্বজনদের দান ও আপ্যায়ন করে ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় সেতু বন্ধন তৈরি করাই আমাদের কুরবানির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের কুরবানির গুরুত্ব বুঝে এর পূর্ণ ফজিলত লাভ করার সুযোগ দিন। আমিন!
লেখক: পিএইচডি গবেষক, উপাধ্যক্ষ; বাঙ্গড্ডা ফাযিল মাদ্রাসা, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য: লাকসাম উম্মুল ক্বোরা দাখিল মাদ্রাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।