বুধবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা আরো বাড়বে নাগরিক সেবায় অনেক অসহনীয় চাপ পড়বে

ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা আরো বাড়বে  নাগরিক সেবায় অনেক অসহনীয় চাপ পড়বে
১৮ Views

           

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ\ ঢাকা রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন নির্মাণে ফোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বাড়ানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগ ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতা ও সামগ্রিক পরিবেশকে আরও হুমকিতে ফেলবে। পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন সামাজিক, পরিবেশবাদী, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনের মতামত ও দাবিকে উপেক্ষা করেই সরকার এই সংশোধনের পথে হাঁটছে। এর ফলে জনবহুল ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা বাড়বে এবং ইতিমধ্যে স্থবির হয়ে যাওয়া শহরে পরিবহন, পরিসেবাসহ সকল ধরনের নাগরিক সেবার উপর অসহনীয় চাপ পড়বে। কিন্তু এই চাপ বহন করবার ক্ষমতা এই শহরের নেই।

            উল্লেখিত এসব মতামত উঠে আসে সম্প্রতি বিআইপি’র কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত “ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগঃ বিআইপি’র পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। বিআইপির সহ.সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিনের সঞ্চালনায়, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ সংক্রান্ত বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনাসমূহ তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

            এতে আরো বলা হয়েছে যে, এই ধরনের উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতাকেও একেবারে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। আবাসিক এলাকার ভবনসমূহের ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরু রাস্তার পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ অনুমোদন বন্ধ করতে হবে।

            তদপুরি, ছয়তলার উপরের ভবনকে বহুতল ভবন বিবেচনায় নিয়ে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনী এনে ভবনে অগ্নি নিরাপত্তামূলক প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের অনৈতিক প্রভাবকে দূর করে পরিকল্পনাবিদদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সুযোগ না দিলে শহরকে বাসযোগ্য করা এবং পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

            সংবাদ সম্মেলনের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২২ সালে গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই নগরায়ণের জন্য এলাকাভিত্তিক এফএআর মান নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ী ও স্বার্থ সংশ্লি মহলের চাপের কারণে বারবার ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, যা ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

            তিনি আরোও বলেন, ড্যাপ এর সাম্প্রতিক প্রস্তাবনায় অধিকাংশ এলাকায় এফএআর ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় অতিরিক্ত তলা নির্মাণের অনুমতি মিলবে, যা যানজট, জলাবদ্ধতা, আলো-বাতাস সংকট ও ইউটিলিটি সেবায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে। খিলক্ষেত, বাড্ডা, বাসাবো-খিলগাঁও, রামপুরা ও মিরপুরসহ অনেক এলাকায় এফএআর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে- অথচ পরিকল্পনাবিদদের দাবিকে উপেক্ষা করে গুলশান-বনানী ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় সামান্য কমানো হয়েছে মাত্র। এতে ফার মানের বৈষম্য আবারও জিইয়ে রাখা হয়েছে এবং প্লট মালিকদের অনার্জিত আয় বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

            তবে বিআইপিসহ অনেক পরিবেশবাদী সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় উন্নয়ন বন্ধের সুপারিশকে তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

            অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সতর্ক করে আরও বলেন, ইতোমধ্যেই দুই কোটির বেশি মানুষের চাপের মধ্যে থাকা ঢাকার জন্য এই ধরনের সংশোধনী টেকসই উন্নয়নকে আরও বিপন্ন করবে। ড্যাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুষম জনঘনত্ব ও মানসম্মত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, কিন্তু বর্তমান সংশোধনী সেই উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি আরোও উল্লেখ করেন যে, ২০২৫ সালের ১৮ই মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপ ও ইমারত বিধিমালা পরিবর্তনের প্রভাব ও নাগরিক করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।

            সংবাদ সম্মেলনটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল­্যানার্স (বিআইপি)সহ ১৫টিরও বেশি নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল। তৎপরবর্তীকালে ড্যাপ নিয়ে উপরোক্ত সংগঠনসমূহের লিখিত সুপারিশ ও দাবি-দাওয়া গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসকল দাবি-দাওয়ার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি ড্যাপের সংশোধনের উদ্যোগে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের ও হতাশার।

            এছাড়া, বিআইপির সহ.সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ড্যাপ পুনরায় সংশোধনের ক্ষেত্রে জনস্বার্থের পরিবর্তে ক্ষমতাশালীদের স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। শহরের উচ্চ জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা মিলিত হয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নই কেবল গুরুত্ব পাচ্ছে।

            সংবাদ সম্মেলনে বিআইপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয় যে, ড্যাপে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধাদি যথা- স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির যে প্রস্তাবনা দেয়া আছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি সংস্থাসমূহকে অতি দ্রæত এলাকাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নে আবাসন ব্যবসায়ীসহ স্বার্থের সংঘাত আছে, এমন কাউকেই অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না। বিগত সময়ে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিকল্পনায় যেসকল পরিবর্তন করা হয়েছে, এসবের ব্যাপারে অন্তর্বতী সরকার কর্তৃক সঠিক তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

            পরিকল্পনা, ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ব্যবস্থা গ্রহণ।

            দেশের পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন এবং মহাপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও আইনের বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ত আবাসন ব্যবসায়ী, শিল্প কারখানার মালিক, রাজনীতিবিদ, আমলা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট পেশাজীবি, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থাসমূহের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

            মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ও পুনর্মূল্যায়নে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদির সুষম বন্টন, এলাকাভিত্তিক সাম্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাধার, কৃষিভূমি-জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

            সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ এবং পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদীনও উপস্থিত ছিলেন।

            মূলতঃ ঢাকা শহরে আবাসন, যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসন করে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার জন্য বিগত ১০৮ বছরে একাধিক মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। তৈরি করা হয় বিভিন্ন মাস্টার প্ল­্যান। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।

            অত:পর, ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণয়ন করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল­্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। ২০২২ সাল থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে এইমহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু মহাপরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই দুই দফা সংশোধন করা হচ্ছে।

            অতি সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে এক সভায় বর্তমান ড্যাপে থাকা রাস্তার ভিত্তিতে ফার (ফোর এরিয়া রেশিও), এলাকাভিত্তিক ফার, আবাসন ইউনিটের  মতো বিষয়গুলো সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে খসড়া ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫ এবং ড্যাপের কিছু সংশোধনীর উপর আলোচনা করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন, উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। সভায় বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, রাজউকের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল­্যানার্স, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থাপত্য অধিদপ্তর ও রিহ্যাবের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

            এ প্রসঙ্গে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ড্যাপ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এলাকাভিত্তিক ফারবাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। তবে গ্রামীণ এলাকার (যেমন দাসেরকান্দি, কাঁচপুর, ময়নারটেক, আলীপুর, রুহিতপুর, বিরুলিয়া, বনগ্রাম) কম বেশি ১৬টি জনঘনত্ব ব্লকের ফার কিছুটা সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সভায় বিবিএস-২০১১ এরহাউজহোল্ড সাইজ বিবেচনায় নিয়ে আবাসন ইউনিট নির্ধারণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। আগামী একবছরের মধ্যে ড্যাপকে (২০২২-২০৩৫) অধিকতর উন্নত করতে সব পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ম একটি কারিগরি কমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটি ঢাকার বাসযোগ্যতা উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজউককে পরামর্শ দেবে।

            উক্ত বৈঠকে অংশ নেয়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অবপ্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান জানান, ড্যাপ আবার সংশোধনে সরকারের উদ্যোগ অনেকটাই এগিয়েছে। মূলতঃ আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির কাছে সরকার রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন নির্মাণে ফোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন সামাজিক, পরিবেশবাদী, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনের মতামত ও দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার এই সংশোধনের পথে হাঁটছে। এতে জনবহুল ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা আরো বাড়বে এবং এরই মধ্যে স্থবির হয়ে যাওয়া শহরে পরিবহন, পরিষেবাসহ সব ধরনের নাগরিক সেবার ওপর অসহনীয় চাপ পড়বে। কিন্তু এই চাপ বহন করার ক্ষমতা এ শহরের নেই। এ ধরনের উদ্যোগ ঢাকার বাসযোগ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। ফোর এরিয়া রেশিও বা এফএআরের মান নির্ভর করে এলাকার বৈশিষ্ট্য, প্ল­টসংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততা, এলাকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও পরিষেবার উপর। এলাকাভেদে এফএআরের মান ভিন্ন হবে। তবে সংশোধনকে আমরা বিরোধিতা করে আসছি।

            ড্যাপ গেজেট প্রকাশের পর দুই দফা সংশোধন: এই মহাপরিকল্পনা কার্যকরের জন্য ২০২২ সালের ২৩শে আগস্ট সরকারিভাবে প্রথম গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরবর্তিতে এক বছর পর বিভিন্ন মহলের চাপে ২০২৩ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এই সংশোধিত ড্যাপ গেজেটভুক্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২২শে জুন জারিকৃত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাস্টার প্ল­্যানের প্রজ্ঞাপন রহিত করা হয়েছে। তবে ওই মাস্টার প্ল­্যানের অধীনে বাস্তবায়িত কাজ কিংবা গৃহীত সিদ্ধান্ত বৈধ বলে বিবেচিত হয়। রাজউকের তত্ত¡াবধানে বাস্তবায়িত ওই মাস্টার প্লানের এখতিয়ারাধীন এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার।

            এর আগেও ২০১০ সালের ২২শে জুন ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তখন এর মেয়াদ ছিল ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত। ওই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অভিজ্ঞতা ও নীতি প্রস্তাবনাসমূহের পর্যালোচনা এবং ঢাকা কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫-এর নীতিমালার আলোকে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫) প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতপার্থক্য নিরসন হয়নি আজ অবধি।

            রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (রিহ্যাব) বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ড্যপা (২০২২-৩৫) বাতিল ও স্থগিতের দাবি জানানো হয়। অপরদিকে, স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে বলে জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাই পরিকল্পিত ও টেকসই ঢাকা গড়ার জন্য ড্যাপ দ্রæত বাস্তবায়নের দাবি ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সসহ (বিআইপি) বিভিন্ন সংগঠনের।

            এ বিষয়ে রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ বলেন, আমাদের দাবির কিছুই পূরণ করা হয়নি। এরিয়া ফার কিছুটা বেড়েছে কিন্তু রোড ফার কমিয়ে দিয়েছে। অপরিকল্পিত এলাকার জনগণ, যাদের জন্য আমরা আন্দোলন বা দেন-দরবার করছিলাম তাদের কোনো উপকার হলো না। কারণ ডেনসিটি অলমোস্ট দুইয়ের নিচে, অর্থাৎ আপনি কাঠা প্রতি দু’টার বেশি প্ল্যাট করতে পারবেন না। ৫ কাঠা জমি হলে আপনি সর্বোচ্চ ১০টা প্লাট বানাতে পারবেন।

            ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণয়ন করা হয়েছে ড্যাপ বাঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। ড্যাপে বøক ভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনায় কিছু জায়গা উন্মুক্ত স্থান রাখার শর্তে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার ইমারত নির্মাণ করার সুযোগ রয়েছে। তবে সকল পক্ষের সঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত  নেবে- তাই কার্যকর করা হবে।’

            ১০৮ বছরে একাধিক মহাপরিকল্পনায় ঢাকার শহরকে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার জন্য ১০৮ বছরে একাধিক মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তৈরি করা হয় বিভিন্ন মাস্টার প্ল্যান। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। সমন্বয়হীনতা ও গুরুত্ব না দেয়ার কারণে পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না এসব মহাপরিকল্পনা। প্ল্যান নেয়ার পর আবার সংশোধন হয়। যে কোনো পরিকল্পিত নগরায়ণে দু’টি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। একটি হলো ভূমি ব্যবহার ও অপরটি হলো পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে ভূমি ওপরিবহন ব্যবস্থা সবচেয়ে বিশৃঙ্খল। তাই কোনো মহাপরিকল্পনাই কার্যকর হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

            ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর- এ দু’টো বাস্তবতাকে ধরেই এই নগরের বিশদ পরিকল্পনা হয়। ঢাকার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এর চার পাশে ৪টি নদী ঘিরে আছে। এ ছাড়া ঢাকায় প্রায় ৫০টির মতো প্রাকৃতিক খাল ছিল। খালগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত এবং পানিজমা হতো না। শহর বড় হওয়া শুরু করলে ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে নগর পরিকল্পনাবিদ স্যারপ্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটা বিশদ পরিকল্পনা করান। সেটিই বিখ্যাত ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’ নামে পরিচিত।

            কিন্তু পরে ১৯৫৯ সালে ‘ঢাকা মাস্টার প্ল্যান’ নামের আরেকটি পরিকল্পনা করা হয়। কমনওয়েলথের কলম্বো প্ল্যানের অধীনে ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ সংস্থা মিনোপ্রিও, স্পেন্সলি এবং ম্যাক ফারলেন এই পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮১ সালে প্ল্যানিং কমিশন প্রথম ঢাকা মেট্রোপলিটন ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যান (ডিএমএআইইউডিপি) তৈরি করে। কিন্তু পরবর্তিতে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তৈরি করে স্ট্রাকচার প্ল্যান ১৯৯৫-২০১৫। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) আরবান এরিয়া প্ল্যান ১৯৯৫-২০০৫ তৈরি করে। ১৯৯৭ সালে এটা পাস করা হয়। পরবর্তিতে তা আর কার্যকর করা হয়নি।

            ২০১০ সালে তৈরি করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ২০১০-২০১৫ সাল। পরবর্তিতে আবার  ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) তৈরি করা হয়। কিন্তু তাও কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫) তৈরি করা হয়। সরকারিভাবে এই মহাপরিকল্পনা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে ৭ বছর। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে এবং সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ২৩শে আগস্ট। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল মাত্র ২ বছর।

            এ ছাড়া, ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়েরিভাইস স্ট্র্যাটেজি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) নামে একটি মহাপরিকল্পনা রয়েছে। দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের সমন্বয়ে এটি তৈরি হয় ২০১৬ সালে। রাজধানীর যানজট ও ঢাকার আশপাশ জেলার পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০০৪ সালে প্রণয়ন করা এই পরিকল্পনা। ২০২৪ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়নে কথা ছিল। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব ও অপরিকল্পিতভাবে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি এসটিপি।

            তাই ২০১৬ সালে নতুন করে প্রণয়ন করা হয়েছে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি)। চার ধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। এতে রাজধানীর যানজট নিরসন ও ঢাকার আশপাশ জেলার পরিবহনব্যবস্থা উন্নয়নে ৬টি ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল ও একটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু তাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তাইআরএসটিপি আবারও সংশোধন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

            এ বিষয়ে পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা নিয়ে ১৯১৭ সালে নগর পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটা বিশদ পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। ওই পরিকল্পনায় গেডিস সাহেব বৃষ্টির পানি যেন প্রবাহিত হয়ে চলে যেতে পারে- সে জন্য নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে সংস্কার ও সংরক্ষণ করার কথা বলেছিলেন। ওটা ঠিক এক থেকে দেড়শ’ বছর আগের কথা। কিন্তু এখনো আমাদের এসব নিয়েই কথা বলতে হচ্ছে।

পরবর্তিতে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করা হয়েছিল। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। তা সংশোধন করা হচ্ছে আবারও।

Share This