বৃহস্পতিবার, ৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

তারেক রহমান-এর সেদিন-এদিন!

তারেক রহমান-এর সেদিন-এদিন!
১১ Views

          

  স্টালিন সরকার\ উপরোক্ত বাঁয়ের ছবির মানুষটিকে চেনা যায়? ১৯৯০ সালের ২১শে নভেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত “আজ দেশব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশ: খালেদা জিয়ার বাসভবনে হামলা: পুত্র তারেক আহত” শীর্ষক প্রতিবেদনে এই ছবি ছাপা হয়েছিলো। প্রতিবেদনটি ছিল এমন- ‘সামরিক বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেকে লে: কর্নেল (অব.) আবদুর রাশিদ পরিচয় দিয়ে ৭ দলীয় জোটনেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসস্থ বাসভবনে জোরপূর্বক ঢুকে পড়েন। লোকটি বেগম জিয়ার খোঁজ করেন, প্রাণনাশের হুমকি দেন। তাকে বাসায় না পেয়ে তিনি বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকে পিটিয়ে আহত করেন।’ অতঃপর রক্তাক্ত তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়। এবার চিনতে পেরেছেন? হ্যাঁ- ছবির আহত মানুষটি আজকের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তখন তিনি মূলত: বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলা শাখা বিএনপি’র সদস্য ছিলেন। দেশের বেশির ভাগ পত্রিকাই “তারেক রহমান গুরুতর আহত” হওয়ার ওই ছবি ছাপেনি। ‘ভবিষ্যতের নেতা বানানো’র চেতনা থেকে আহত পুত্রের ছবি ফলাও করে প্রচারের চেষ্টা করেননি আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানো এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর কারণে-অকারণে নতুন দলের নেতাদের সামান্য আহতের খবর যেভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয়; গোটা প্রশাসনযন্ত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে মাঠে ক্যাম্পেইনে নামছে। নতুন দলের নেতাদের দেশবাসীর কাছে পরিচিত করে তোলার কৌশল সেদিন তরুণ নেতা তারেক রহমানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি! স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএনপি, বাম দলগুলো এরশাদের পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে। এর ৪ বছর আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ‘এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে জাতীয় বেঈমান হবে’ ঘোষণা দিয়ে রাতে দিল্লির মধ্যস্থতায় রফাদফা করে এরশাদের অধীনে নির্বাচন করে শেখ হাসিনা ’৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। কিন্ত এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ‘সংসদের সংসার’ বেশি দিন টেকেনি। সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হলে শেখ হাসিনা যুক্ত হন আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চলমান রাজপথের আন্দোলনে। এরশাদের পতনের দাবিতে তিন জোট ঐক্যবদ্ধ হলে রাজপথে গড়ে উঠে তীব্র আন্দোলন। আন্দোলনের কর্মসূচি ঠেকাতে স্বৈরশাসক এরশাদের অলিগার্করা তারেক রহমানকে পিটিয়ে আহত করেন।

            ক্যালেন্ডারের পাতা পেছনে উল্টালে দেখা যায়, তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিতে যোগদানের আগে থেকেই মায়ের সঙ্গে রাজনীতির স্রোতধারায় ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে বগুড়া গাবতলী উপজেলা শাখা বিএনপির সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। অতপর: ২০০২ সালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ২০০৯ সালে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান।

            ্এর আগে ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনে গেলে বেগম খালেদা জিয়া রাজপথের আন্দোলনে আপসহীন নেত্রী হয়ে উঠেন। সে সময় এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার একাধিকবার মায়ের সঙ্গে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন।

            তবে নেত্রী খালেদা জিয়া ও বাম নেতারা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন পুরোভাগেই। শেখ হাসিনা ’৮৬ সংসদ বাসর’ থেকে বের হয়ে আসায় এরশাদ ৮৮ সালে আ স ম রবকে কাছে টেনে পাতানো নির্বাচন করেন। এতে করে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন শেখ হাসিনা এবং এরশাদ পতন আন্দোলনেও যোগ দেন তিনি। ১৯৯০ সালের ১৯শে নভেম্বর এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৩ জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। তখনও ক্ষমতা ধরে রাখতে অটল থাকেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন খাঁন সউদী আরব সফরে ছিলেন। এরশাদের আদেশ অনুযায়ী আন্দোলন ঠেকাতে সেনাবাহিনী মাঠে নামলেও এরশাদের আদেশ পুরোপুরি অমান্য ও পালন করতে পারছিল না; আবার জনতার উপর গুলি চালাতেও চাচ্ছিল না। সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খান দেশে ফেরার পর সেনাবাহিনীর সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ রাজপথের আন্দোলন “ডান্ডা মেরে ঠান্ডা” করার নির্দেশ দিলে নূর উদ্দিন জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়ার বার্তা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন। উপায়ান্তর না দেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন এরশাদ।

            অত:পর, এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তারেক রহমান মা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং তারেকের প্রচেষ্টায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ২০০৫ সালে তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল সম্মেলন আয়োজন করেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা ইউনিটের সাথে মতবিনিময়ের নতুন ধারা চালু করেন। দিল্লির নীলনকশা অনুযায়ী ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ওই বছরের ৭ই মার্চ তারেক রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তার এবং তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। দিল্লির অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী লোকদেখানো সংস্কারের নামে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ উত্থাপন করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘সাইজ’ করা হয়। এর মধ্যেই চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারেক রহমান লন্ডনে চলে যান।

মূলত: তরুণ তারেক রহমানের যখন রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে- তখন এখনকার মতো এত অগণিত গণমাধ্যম ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়াও আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি চাইলে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় নব্বই সালে আহত তারেক রহমান এবং ওয়ান-ইলেভেনের পর পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার তারেক রহমানকে নিয়ে ব্যাপক ক্যাম্পেইন করতে পারতেন; জনগণের সহানুভূতি আদায় এবং পরিচিতিও অর্জন করা যেতো। কিন্তু সে পথে হাঁটেনি বিএনপি ও তারেক রহমান। স্বাধীনতার ঘোষক এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র হলেও একেবারে উপজেলায় তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি শুরু করেন তারেক রহমান। অথচ বর্তমান তরুণ নেতাদের জাতীয় নেতা বানানোর একি প্রচারণা! ৫ই আগস্টে শেখ  হাসিনা পালানো এবং ৮ই আগস্ট অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের ‘জাতীয় নেতা’ বানানোর যেনো প্রচারণার মহাযজ্ঞ চলছে।

            ওদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেছে। দলটির কয়েকজন নেতা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলে তা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দলটির নেতারা বক্তব্য দিলেই তা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ১৯৯০ সালের ২০শে নভেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের অলিগার্করা বেদম প্রহার করে তারেক রহমানকে রক্তাক্ত করেছিল; সে খবর দেশের সব গণমাধ্যমে কোনোই গুরুত্ব পায়নি। কেবল ইনকিলাবে সচিত্র ছবিসহ খবরটি গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছিলো। অথচ এনসিপি নেতাদের গায়ে আছর লাগলেই তা খবরের শিরোনাম হচ্ছে। গণমাধ্যম ফলাও করে সে খবর প্রচার করছে ওই নেতাদের জনগণের সামনে পরিচিত করতে। শুধু গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়াই নয়; প্রশাসনযন্ত্র ওই নেতাদের জাতীয়ভাবে পরিচিত করে তুলতে চেষ্টা করছেন!

            অথচ, মার্কেটিংয়ের জনক ফিলিপ কটলার বলেছেন, ‘মার্কেটিং হচ্ছে মুনাফার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে পণ্য প্রদান করা।’ আপনি যদি বাজারজাত (মার্কেটিং) রাজনীতির ক্ষেত্রে দল ও নেতাকে পরিচিত করে তুলতে চান, তাহলে আপনাকে জানতে হবে- মানুষ এই প্রোডাক্ট বা রাজনৈতিক দলকে নিয়ে কী চিন্তা করে; দলটির নেতারা মানুষের কাছে পরিচিত কিনা? আর মানুষকে প্রভাবিত করতে এবং মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলতে প্রচারণা জরুরি।

            সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষকের সন্তান; কিন্ত রাজনীতিতে সেদিন তরুণ নেতা তারেক রহমান জুলুম-নির্যাতনের শিকার হলেও তাকে ‘নেতা বানানোর’ কোনো প্রচারণায় দেখা যায়নি। অথচ বর্তমানে নতুন দলের তরুণ নেতাদের দেশবাসীর কাছে ‘পরিচিত’ করে তুলতে কৌশলের যেন শেষ নেই। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পরিচিত করে তুলতে মার্কেটিংয়ের কৌশলে সাময়িক প্রচারণা পাওয়া যায় বটে; আখেরে কোনো লাভ হয় না। তারেক রহমান যেদিন যেমন নিজেকে নেতা হিসেবে পরিচিত করে তুলতে ‘প্রপ্রচারণা মিশন’ করেননি; তিনি তেমনিই রয়ে গেছেন এখনো।

Share This