নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক কতটুকু প্রস্তুত?
ড. মো. রফিকুল ইসলাম\ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী তরুণ, যার জনমিতিক সুফল পেতে হলে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা জরুরি। এ কারণেই শিক্ষার রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। শিক্ষা হবে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর ও সর্বজনীন। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট বয়স ও শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কী ধরনের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে, তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল হচ্ছে শিক্ষাক্রম। তাই জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিবেশ এবং চাহিদা ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার আলোকে শিক্ষাক্রম প্রণীত হওয়া প্রয়োজন।
জানা যায়, দেশের নতুন শিক্ষাক্রম ফিনল্যান্ড ও অন্যান্য দেশের মডেল অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। এ কারিকুলামে প্রাক-প্রাথমিক স্তর হবে ২ বছর, যা ২০২২ সাল পর্যন্ত ১ বছর ছিল। প্রাক-প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ নার্সারি ও প্লেতে শিশুর জন্য কোনো নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক থাকছে না। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই তাদের নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকার সিদ্ধান্তটি সার্বিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কতটুকু সহায়ক হবে, তা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার।
এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি না করে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা এক নয়। নতুন কারিকুলাম প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক এবং বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এর পাশাপাশি শিল্পকলা (বিদ্যমান চারু ও কারুকলা), ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা। এগুলোর মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাৎ ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক এবং বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর বছর শেষে পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশের ওপর। আর জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি (বিদ্যমান চারু ও কারুকলা) বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
অন্যদিকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক এবং বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ আর বছর শেষে পরীক্ষা হবে ৫০ শতাংশের ওপর। অর্থাৎ দশম শ্রেণির শেষে ৫০ শতাংশ নম্বরের এসএসসি পাবলিক পরীক্ষা হবে। আর অন্যান্য বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখা থাকবে না। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাজন চালু করা হয়েছিল। বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সেখানে কেন বিজ্ঞানের প্রতি গুরুত্ব কমানো হলো, তা বোধগম্য নয়। কেন্দ্রীয়ভাবে পিইসি, ইবতেদায়ি ও জেএসসি/জেডিসি পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না।
এদিকে এসএসসি ও সমমানের পর্যায়ে শুধু দশম শ্রেণিতে যা পড়ানো হবে, এর ওপর ভিত্তি করে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষা হবে ৭০ শতাংশের ওপর। বিশেষ করে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণিতে শাখা পছন্দ করতে পারবে।
এমন ব্যবস্থা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে চালু ছিল। এদিকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি পৃথক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নির্ণয় করা হবে। আর সৃজনশীল ও গ্রেড পদ্ধতি উঠে যাবে। এক্ষেত্রে তিনটি স্তরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে। যথাক্রমে প্রথম স্তর এলিমেন্টারি, দ্বিতীয় স্তর মিডল লেভেল এবং তৃতীয় স্তর এক্সপার্ট লেভেল।
প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসাবেই দেখতে হবে। কিন্তু শিক্ষকরা কি সঠিক ও কার্যকরভাবে শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে মূল্যায়ন করতে সক্ষম? সারা বছর মূল্যায়ন করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে? এ ধরনের মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকরা কতটা প্রস্তুত?
এছাড়া স্থানীয় নানা চাপ উপেক্ষা করে শিক্ষকরা কি আদৌ যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারবেন? বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকদের সারা বছর ধরে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, খেলাধুলা, গ্রæপ-ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার, প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। এর মূল্যায়ন মান বর্তমানের মতো প্রচলিত পরীক্ষা নয়; নম্বর নয় আর গ্রেডিং নয়। এর নতুন পদ্ধতিতে মন্তব্যগুলো হবে ‘খুব ভালো’, ‘ভালো ও সন্তোষজনক’ এবং ‘আরও শেখানো প্রয়োজন’।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থার সব ধারাকে বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘বুকিংস রিপোর্ট (২০১৬) অন স্কিলস ফর চেঞ্জিং’-এর প্রতিবেদনে ১০২টি দেশের মধ্যে ৭৬টি দেশের কারিকুলামে সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতাকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর ৫১টি দেশের কারিকুলাম সম্পূর্ণ রূপান্তরমূলক দক্ষতাভিত্তিক করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় দেখা যায়-ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের কাজ করছে। বাংলাদেশও একইভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি সার্বিক পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করছিল। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও নৈতিকতা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনে যথোপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন কারিকুলাম এ লক্ষ্য অর্জনে কতটা সক্ষম হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম