নারীর নীরব ঘাতক স্তন ক্যানসার: সময়মতো সচেতনতা জীবন বাঁচায়


স্তন ক্যানসার — শব্দ দুটি অনেক সময় আমাদের মনে ভয় জাগায়। কিন্তু এই ভয়ই যদি সচেতনতার জায়গা নেয়, তবে অজস্র প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখো নারী এই রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশেও প্রতি বছর হাজার হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, আর অনেকেই দেরিতে চিকিৎসা শুরু করার কারণে জীবন হারাচ্ছেন। অথচ সময়মতো সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা পেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্তন ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
স্তন ক্যানসার কী?
স্তনের টিস্যুতে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি পেলে এবং সেই কোষগুলো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে শুরু করলে তাকে স্তন ক্যানসার বলা হয়। এটি সাধারণত এক জায়গা থেকে শুরু হয়ে আশপাশের টিস্যু, এমনকি শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
স্তন ক্যানসারের প্রধান কারণসমূহ
স্তন ক্যানসারের নির্দিষ্ট কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা গেছে, যেমনঃ
-
বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে, বিশেষত ৪০ বছরের পর।
-
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের কেউ আগে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
হরমোনের প্রভাব: দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা হরমোন থেরাপি গ্রহণ করলে।
-
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
-
অ্যালকোহল সেবন ও ধূমপান।
-
প্রথম সন্তান দেরিতে নেওয়া বা সন্তান না নেওয়া।
-
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
প্রাথমিক উপসর্গগুলো চেনা শিখুন
প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে স্তন ক্যানসার চিকিৎসাযোগ্য। তাই নিচের বিষয়গুলো খেয়াল করুনঃ
-
স্তনে গাঁট বা শক্ত অংশ অনুভব হওয়া
-
স্তনের আকার বা আকৃতিতে হঠাৎ পরিবর্তন
-
স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বা অস্বাভাবিক তরল নিঃসরণ
-
স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া
-
স্তন বা বগলে ব্যথা বা ফোলা ভাব
-
ত্বকে কুঁচকে যাওয়া বা ডিমের খোসার মতো দাগ পড়া
যদি এসবের কোনো একটি উপসর্গও দেখা দেয়, তবে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কীভাবে পরীক্ষা করবেন — স্ব-পরীক্ষা (Self-examination)
প্রতি মাসে একবার নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
🩷 সময়: মাসিক শেষ হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর (যখন স্তন নরম থাকে)।
🩷 ধাপসমূহ:
-
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্তনের আকার, ত্বক ও স্তনবৃন্ত পর্যবেক্ষণ করুন।
-
হাতে স্পর্শ করে স্তনের চারপাশে কোনো গাঁট বা শক্ত জায়গা আছে কি না দেখুন।
-
বগলের নিচেও পরীক্ষা করুন, কারণ অনেক সময় গাঁট সেখানেও হতে পারে।
যদি কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের পর্যায় ও ধরন অনুযায়ী।
চিকিৎসার মধ্যে থাকতে পারে:
-
অপারেশন (Surgery)
-
কেমোথেরাপি (Chemotherapy)
-
রেডিওথেরাপি (Radiotherapy)
-
হরমোন থেরাপি (Hormone Therapy)
প্রতিরোধের জন্য যা করতে পারেন:
-
নিয়মিত স্ব-পরীক্ষা ও ডাক্তারের স্ক্রিনিং।
-
সঠিক খাদ্যাভ্যাস: সবজি, ফল, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার।
-
অ্যালকোহল ও ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করা।
-
স্তন্যদান করা, যা প্রাকৃতিকভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
মানসিক শক্তি সবচেয়ে বড় অস্ত্র
ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। সময়মতো সনাক্তকরণ, যথাযথ চিকিৎসা ও মানসিক দৃঢ়তা একজন রোগীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব হলো রোগীকে ভালোবাসা, সাহস ও সহানুভূতি দেওয়া।
উপসংহার
“সচেতনতাই বাঁচাতে পারে জীবন।”
প্রতি নারীকে নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আর প্রতিটি পুরুষেরও দায়িত্ব আছে — মা, বোন, স্ত্রী বা বন্ধুর স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকা।
একটি ছোট পরীক্ষা, একটি সময়মতো পদক্ষেপ — হয়তো বাঁচাতে পারে একটি জীবন।
চলুন সবাই মিলে বলি —
“স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতন হোন — জীবন বাঁচান।”