নিরাপদ খাদ্য শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য


ড. মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান\ আমরা সবাই জানি, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক উপাদানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য। খাদ্য ব্যতীত জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সেই খাদ্য হতে হবে নিরাপদ, যা বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক যেমন: কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ইত্যাদি এবং অন্যান্য দূষক যেমন: ভারী ধাতু, মাইকোটক্সিন ইত্যাদি হতে মুক্ত হবে অথবা এ সমস্ত দূষকের উপস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ের নিচে থাকবে। অন্যদিকে যদি খাদ্যদ্রব্যে এ সমস্ত দূষকের উপস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ের উপরে থাকে, তাহলে সেটি হয়ে যায় দূষিত খাদ্য। আর এ দূষিত খাদ্যই তৈরি করছে মানবদেহে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধি। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকার তথ্যমতে, দেশে ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ কৃষক পরিবারের। কারণ, কৃষকরা প্রতিনিয়তই এ বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশকসমূহ তাদের ফসলে প্রয়োগ করে থাকে কোনরকম স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ব্যতিরেকেই।
আমরা প্রতিদিন যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করে থাকি তার মধ্যে ফল-মূল ও শাকসবজি অন্যতম। ফল-মূল ও শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ফাইবার, মিনারেল ইত্যাদি, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের অন্তত ৪০০ গ্রাম ফল-মূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করা উচিত। কিন্তু উৎপাদনকারীরা এ সমস্ত ফল-মূল ও শাকসবজি উৎপাদন করতে যেয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হয় সেটি হলো, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। কাজেই কৃষকেরা রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। এ সমস্ত বালাইনাশকের ব্যবহার শুধুমাত্র ফসলের উৎপাদন খরচই বৃদ্ধি করে না বরং ফল-মূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থের জন্য বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাবে আজ জীব-বৈচিত্র্য হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের মাছসহ অন্যান্য অনেক প্রজাতির জীব।
কীটতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারের বিগত ১৮ বছরের ফলাফল হতে প্রতিয়মান হয় যে, বাজার হতে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রকার সবজির নমুনাসমূহের মধ্যে শতকরা ১০-১২ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে এবং বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের নমুনাসমূহের মধ্যে শতকরা ৩-৪ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে। সালাদ জাতীয় ফসল যেমন: ক্যাপসিকাম, লেটুসপাতা, ধনিয়া পাতা, গাজর ইত্যাদির ক্ষেত্রে শতকরা ১০-১৫ ভাগ নমুনাতে এবং পান ফসলের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার উপরে। ফসল উৎপাদনকারী তার ফসলকে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনুমোদিত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত নিয়ম কানুন রয়েছে সেগুলো অবশ্যই তাকে মেনে চলতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, হংকং, তাইওয়ান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশসমূহ বাংলাদেশের তুলনায় যথাক্রমে ৯.৪, ৭.৫, ৭.৪, ৭.০ এবং ৬.৭ গুণ বেশি রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কম হলেও আমাদের দেশের কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করেন না। যেমন: ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া একই ফসলে বার বার বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। সবচেয়ে প্রধান যে সমস্যাটি আমাদের দেশের কৃষকগণ করে থাকে সেটি হলো বালাইনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমান সময় (চৎব-যধৎাবংঃ রহঃবৎাধষ, চঐও) পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ফসল সংগ্রহ ও বাজারজাত করেন। ফলে প্রতিদিনই আমরা ভক্ষণ করছি বিষাক্ত খাবার।
ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেমান সময় (চঐও) বলতে বুঝায় কোন ফসলে সর্বশেষ রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের পর হতে ফসল সংগ্রহের পূর্বে ন্যূনতম কত দিন অপেক্ষা করলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ, গজখ) নিচে চলে যাবে। এই অপেক্ষমাণ সময় ফসলভেদে ও বালাইনাশকের প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন: সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৪-৬ দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৭-২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২২ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে ২০-৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষমান সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে যদি ফল-মূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করা হয়, তবে ফল-মূল ও শাকসবজিতে ব্যবহৃত বালাইনাশকসমূহের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায় বা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে চলে যাবে। উল্লেখিত নিয়ম-কানুনসমূহ মেনে উৎপাদনকারীগণ সহজেই বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার না-করেও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে। আমাদের দেশের কৃষকরা সাধারণত রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের ১-২ দিন পরেই ফসল সংগ্রহ করে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। আর এ কারণেই আমরা আক্রান্ত হচ্ছি নানা রোগব্যাধিতে। কাজেই অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি ফসল সংগ্রহের পূর্বে বালাইনাশকের প্রকারভেদ ও ফসলের ধরনের ওপর ভিত্তি করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয়।
বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেক্ষমাণ সময় বিভিন্ন উপাদান, যেমন: বালাইনাশকের ভৌতরাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, বালাইনাশকের প্রকারভেদ, বালাইনাশকের প্রয়োগের পদ্ধতি, সংশ্লি ফসলের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন প্রকার পরিবেশগত উপাদান যেমন, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। কাজেই প্রতিটি দেশের পরিবেশগত অবস্থার উপর ভিত্তি করে বালাইনাশক সমূহের ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেক্ষমান সময় নির্ধারণ করা দরকার। এ লক্ষ্যেই ২০০৯ সাল থেকে কীটতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রকার বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেক্ষমাণ সময় নির্ধারণের জন্য কাজ করে আসছে। উক্ত গবেষণাগার হতে প্রধান প্রধান শাকসবজিতে যে সমস্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের ফসল সংগ্রহ পূর্ব অপেক্ষমান সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করা উচিত।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বালাইনাশক গবেষণা ও পরিবেশ বিষতত্ত¡ শাখা, কীটতত্ত¡ বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।
