বৃহস্পতিবার, ৩১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা

বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা
১৬৮ Views

            সজীব আহমেদ॥ বছরজুড়েই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ছিল। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যা স্বল্প আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। বিষয়টি বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

গত আগস্টের শুরুতে সরকার বদলের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ও কাঁচাবাজারগুলোতে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে আসে। এতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে বলে ভেবেছিলেন ভোক্তারা। কিন্তু পণ্যের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। চাল, ভোজ্য তেল, মাছ, মাংস, আলু, পেঁয়াজ ও রসুনসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল না।

            গত এক বছরের ব্যবধানে চাল, সয়াবিন তেল, দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, আলু, ডিম ও ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে।

            খাদ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বতী সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে, আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা যে খুব বেশি কার্যকর নয়, তা ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্তর বেশ ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে। অন্তর্বতী সরকারের কাছে বাজারে দ্রুত স্বস্তি ফেরানোর আহ্বান ভোক্তাদের।

            ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ চাল, আলু, আটা, ডিম, মাংসের দাম বাড়তে শুরু করে। তারপর আর বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমেনি। এরপর ভারত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করলে হঠাৎ তা কয়েক দফায় দাম বেড়ে দেশি পেঁয়াজ ১৫০ টাকায় উঠে যায়। চলতি বছর এক পর্যায়ে ডিমের দাম বেড়ে ডজনপ্রতি ১৮০ টাকায় ওঠে। সরবরাহের ঘাটতির কথা বলে আলুর দাম উঠে যায় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।

            সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে ভোক্তাদের কিনতে হয়। সম্প্রতি বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে সংকট তৈরি করে কম্পানিগুলো। পরবর্তী সময়ে সরকার লিটারে আট টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। মুরগির মাংসের দামও বেড়ে যায়। ব্রয়লারের কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকায় ওঠে। সোনালি মুরগি ৩০০-৩২০ টাকায় ঠেকে। বছরের এক পর্যায়ে সবজির দামও বেড়ে গোল বেগুন কেজি ১৬০ টাকায় ওঠে, কাঁচা মরিচ কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। বাজারে সব ধরনের সবজির দামও ১০০ টাকার ঘরে ওঠে।

            সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চলতি বছরের ডিসেম্বর এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক বছরে মোটা চাল ব্রি-২৮ ও পাইজম কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৫ শতাংশ দাম বেড়ে ৫৬ থেকে ৬৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্য তেল সয়াবিন খোলা তেল কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬৩ থেকে ১৬৫ টাকায়। দেশি পেঁয়াজ ৮ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে কেজি ৫০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুন কেজিতে ৫ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ২৩০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরের শেষ ছয় মাস অস্থির ছিল আলুর বাজার। কেজিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭৫ টাকায়। ডিমের দাম বছরের শেষ দুই মাস অনেকটা সহনীয় থাকলেও বছরের বাকি ১০ মাসই অস্থির ছিল। ডিম হালিতে ৫ থেকে ১১ শতাংশ দাম বেড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ৩ থেকে ৫ শতাংশ দাম বেড়ে ১৮৫ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

            এবার আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। পাইকারিতেই বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। এতে চাপে থাকা ভোক্তারা আরো চাপে পড়েছে। এবার খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছে। ৮ই আগস্ট অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি।

            অন্য পণ্যের মতো মুরগি ও ডিম সিন্ডিকেটও মাথাচাড়া দেয়। বাধ্য হয়ে সরকার খুচরা পর্যায়ে ডিমের ডজন ১৪৪ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৮০ ও সোনালি মুরগির দাম ২৭০ টাকা কেজি বেঁধে দেয়। যৌক্তিক মূল্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেয়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দর বাস্তবায়নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতেও সরকার নির্ধারিত দরে পণ্য কিনতে পারেনি ভোক্তারা।

            প্রায় সারা বছর বাজারে অনেকটাই চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও মৌসুম শুরু হওয়ায় ক্রেতার নাগালে রয়েছে সবজির দাম। এখন ভোক্তারা ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যেই সবজি কিনতে পারছে। যদিও গত দুই থেকে তিন মাস আগেও ১০০ টাকার নিজে সবজি কিনতে পারেনি ভোক্তারা।

            কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ মূলত দেশে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন ভালো না হওয়া। বাজারের সরবরাহ সংকট কাটাতে পণ্য আমদানি করে যে নিয়ে আসবে সেটাও পর্যাপ্ত ছিল না। কারণ ডলারের সংকটে ঠিকমতো এলসি খোলা যাচ্ছিল না এবং ডলারের সঙ্গে টাকার বড় অবমূল্যায়নে পণ্যের দাম আরো বেড়ে গেছে। এতে খাদ্য মূল্যফীতি বেড়ে মানুষকে কষ্ট দিয়েছে।’

            কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের দামে অস্থিরতা ছিল। এতে ভোক্তারা খুবই কষ্টে ছিল। নতুন বছরের জন্য আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নিত্যপণ্য ও ভোগ্য পণ্য নিয়ে যেন আর ভোগান্তি না বাড়ে।’

Share This