বিপদে ধৈর্যধারণ মুমিনকে কল্যাণের বার্তা দেয়


মুফতি আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ্\ আমরা আমাদের জীবনে চলার পথে বহু বিপদ-আপদ, বালা-মুসীবত ও নানাবিধ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হই। অনেক সময় এসব পরিস্থিতিতে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, বিরক্ত হই এবং নৈরাশ হয়ে যাই। কিন্তু আমাদের উপলব্ধি করা উচিত, ভালো-মন্দ, সুসময় কিংবা দুঃসময় যা কিছু ঘটে, সবই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও হুকুমে সংঘটিত হয়।
আল্লাহ তাআলা কখনো আমাদেরকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার কখনো ওই বিপদের মধ্য দিয়েই আমাদের উপর কল্যাণ ও রহমত বর্ষণ করেন; কিন্তু তা আমরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারিনা। হযরত রাসূল (সা.) বলেছেন- আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৬৪৫]
সুতরাং বিপদে আমাদের ধৈর্যহারা হওয়া কিংবা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। বরং মুমিনের উচিত, বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করা এবং সেই সঙ্গে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, এটাই আমাদের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব।
বিপদে ধৈর্যধারণ করার বিষয়টি বোধগম্য, কিন্তু বিপদে শুকর আদায়ের কোনো ব্যাপার থাকতে পারে কি? হ্যা, ধৈর্যধারণের পাশাপাশি বিপদে শুকর আদায়েরও ব্যাপার রয়েছে। বিপদেও কেন শুকর আদায় করতে হবে? ওলামায়ে কেরাম এর কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন- প্রথমত: আল্লাহ তাআলা আমাকে যে বিপদ দিয়েছেন, এর ওসিলায় হয়তো তিনি বড় বিপদ থেকে আমাকে রা করেছেন। দ্বিতীয়ত: আল্লাহ আমাকে যে বিপদ দিয়েছেন, এর মধ্য দিয়ে হয়তো তিনি আমাকে বড় ধরনের উপকার বা দয়া করেছেন, যা আমি স্বল্প জ্ঞানের কারণে উপলব্ধি করতে পারিনি। তৃতীয়ত: আমার উপর আরোপিত বিপদের কারণে আল্লাহ তাআলা হয়তোবা আমার গোনাহসমূহ মাফ করে দিয়েছেন। চতুর্থত: এই বিপদ দিয়ে হয়তো তিনি পরকালে আমাকে একটি বড় বিপদ থেকে রা করবেন। পঞ্চমত: এই বিপদের কারণে হয়তো তিনি জান্নাতে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন।
মোটকথা, কেউ যদি বিপদে পড়ে সবর করে, তখন আল্লাহ পাক তাকে পুরস্কৃত করবেন- এ তো স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমাদের জন্য আশার বাণী হলো, বিপদে সবর করার পাশাপাশি যদি ঐ বিপদসঙ্কুল অবস্থায় শুকর আদায়ও করা হয়, তখন আমাদের জন্য রয়েছে দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা।
নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান, তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন। [জামে তিরমিযী, হাদীস-২৩৯৬]
অত্র হাদিসের আলোকে বলা যায়, মুমিন বান্দা নিজের কৃত অপরাধের কারণেও বিপদের মুখোমুখি হতে পারে, আবার বিপদাক্রান্ত হতে পারে প্রভুর সঙ্গে তার ভালোবাসার যাচাইস্বরূপও। যে কারণেই হোক, অনাকাক্সিত এ বিপদও তার জন্য রহমত হয়ে থাকে। বিপদ যদি অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এ বিপদে ভুগে সে গোনাহমুক্ত হয়ে ওঠে। আর বিপদ যদি হয় প্রভুর প্রতি তার ভালোবাসার পরীক্ষাস্বরূপ, তাহলে ধৈর্যধারণ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে ভালোবাসার বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে।
সুতরাং বলা যায়, বিপদ-মুসিবত হল নেয়ামত। কারণ এতে গোনাহ মাফ হয়। বিপদে ধৈর্যধারণ করলে তার প্রতিদান পাওয়া যায়। অতএব বান্দার বিপদ-আপদে যদি গোনাহ ক্ষমা হয়, পাপগুলো ঝরে যায়; তবে মুমিনের জন্য এর চেয়ে উত্তম নেয়ামত আর কী থাকতে পারে। আর বিপদ-মুসিবত যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে ধৈর্য ও আনুগত্য সৃষ্টি করে, তবে এই মুসিবত তার জন্য দীনের ক্ষেত্রে বিশাল নিয়ামত হিসেবে প্রকাশ পায়।
বিপদ মুমিনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে কল্যাণকর হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘বস্তুত তোমরা এমন বিষয়কে অপছন্দ করছো যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক। পক্ষান্তরে তোমরা এমন বিষয়কে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহ্ই অবগত আছেন আর তোমরা অবগত নও’। [সূরা বাকারা, আয়াত : ২১৬]
আল্লাহ অনেক সময় তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য এমন সব অবস্থায় ফেলেন, যেগুলো তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে খারাপ বলে মনে হয়; কিন্তু তারা যদি ওই অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তাহলে সে খারাপ অবস্থাটাই তাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। এ ব্যাপারে নবী করীম (সা.) বলেন- ‘মুমিনের বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যজনক। নিশ্চয়ই তার প্রতিটি অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা মুমিন ছাড়া আর কারো জন্যই নয়। সুতরাং, যখন সে কোন বিপদে পতিত হয় তখন সে ধৈর্যধারণ করে। ফলে সে বিপদ তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। আবার যখন তাকে সুখের মধ্যে রাখা হয় তখন সে (আল্লাহর প্রতি) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। ফলে সে সুখও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’। [সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৯৯৯]
অবস্থা দৃষ্টে বিপদের মধ্যে অকল্যাণ মনে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আমাদের কাছে কল্যাণের সুমহান বার্তা নিয়ে আগমন করে। হযরত মূসা (আ.)-কে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর মাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; হযরত ইউসুফ (আ.)-কে মেরে ফেলার জন্য কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; হযরত মারইয়াম (আ.) কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই হযরত ঈসা (আ.)-কে অলৌকিকভাবে জন্ম দিয়েছিলেন; হযরত আয়েশা (রা.)-কে মিথ্যা কলঙ্কে অভিযুক্ত করা হয়েছিল; হযরত ইউনুস (আ.)-কে তিমি মাছ গিলে ফেলেছিল; হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল; হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
একবার ভেবে দেখুন তো, এই ঘটনাগুলো ঘটার সময় লোকেরা কী ভেবেছিল? আর পরবর্তীতে ঘটনাগুলো কোন দিকে মোড় নিয়েছিল! নিশ্চয়ই পরবর্তী অবস্থা অনেক সুন্দর ও মোবারকময় হয়েছিল। অতএব, দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। আপনার জন্যও রয়েছে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নানা কল্যাণ ও শুভ পরিকল্পনা। প্রকৃত ঈমানদারের জন্য ভাল-মন্দ উভয়টিই কল্যাণকর হয়ে থাকে। বিপদের মধ্য দিয়েও যে আল্লাহ আমাদের উপর দয়া ও উপকার করেন, তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হল-
কোন এক যুগে সমুদ্রের মাঝখানে একটি জাহাজ প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়ে বাতাস ও ঢেউয়ের প্রকোপে ডুবে গেল এবং যাত্রীরা অধিকাংশই ডুবে মারা গেল। সেই জাহাজের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী ভাসতে ভাসতে নির্জন এক দ্বীপে এসে পৌছালো। জ্ঞান ফেরার পর প্রথমেই সে আল্লাহর দরবারে প্রাণখুলে শুকর আদায় করলো তার জীবন বাঁচানোর জন্য। তারপর বাড়ীতে ফিরে যেতে চেষ্টা শুরু করল। প্রতিদিন সে দ্বীপের তীরে এসে বসে থাকতো, যদি কোন জাহাজ সেদিকে আসে এই আশায়। কিন্তু প্রতিদিনই তাকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হতো। এরই মধ্যে সে সমুদ্র তীরে থাকার জন্য ছোট একটি ঘর তৈরি করল। সমুদ্রের মাছ শিকার করে এবং বন থেকে ফলমূল খেয়েই তার সময় কেটে যায়।
একদিন সে খাবারের খোঁজে বনের গভীরে প্রবেশ করল। বন থেকে ফিরে সে দেখতে পেল যে, তার রান্না করার চুলা থেকে আগুন লেগে পুরো ঘরটিই ছাই হয়ে গিয়েছে এবং কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেছে। লোকটি চিৎকার করে উঠল আর বলল, হায় আল্লাহ! তুমি আমার এত কষ্টের ঘরটিও শেষমেশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিলে! এই বলে সে মাতম করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
পরদিন সকালে একটি জাহাজের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে দেখতে পেল- জাহাজটি তাকে ইঙ্গিত করে দ্বীপের দিকেই আসছে। আসতে আসতে যখন জাহাজটি দ্বীপে নোঙ্গর তুলল, তখন অসহায় লোকটি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলল, আপনারা এখানে কী উদ্দেশ্যে আসলেন? জাহাজের ক্যাপ্টেন বলল, আমরা আপনাকে উদ্ধার করার জন্যই এখানে এসেছি। লোকটি অবাক হয়ে বলল, আপনারা কিভাবে জানলেন যে, আমি এখানে আটকা পড়ে আছি? জাহাজের ক্যাপ্টেন জানালো- দূর থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে, এই দ্বীপে আগুন জ¦লতেছে। এতেই আমরা বুঝতে পেরেছি, নিশ্চয়ই এখানে কোন মানুষ বিপদের মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি। লোকটি তখন বুঝতে পারল- ঘরে আগুন না লাগলে জাহাজ কর্তৃপক্ষ এখানে কখনোই আসতো না। আর আমিও কখনো বাড়ীতে ফিরে যেতে পারতাম না। আল্লাহ যা করেন, তা মানুষের কল্যাণের জন্যই করেন। কিন্তু আমরা তা না বুঝতে পেরে অহেতুক আহাজারি করি।
উপরের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হল, সকল বিপদ-আপদ ও বালা-মুছীবতে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে ধৈর্যের সাথে বিপদ-মুছীবতকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে হবে এবং সর্বদা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’।
লেখক: মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুসসুন্নাত জামেয়া নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর।