শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বৃহত্তর লাকসামের বিভিন্ন নদ-নদী আর খালে-বিলে  কচুরিপানার ভয়াবহ সর্বনাশ; দেখার মতো কেউ নেই !

বৃহত্তর লাকসামের বিভিন্ন নদ-নদী আর খালে-বিলে কচুরিপানার ভয়াবহ সর্বনাশ; দেখার মতো কেউ নেই !

            শহীদুল্লাহ ভ‚ঁইয়া শুধু লাকসাম আর মনোহরগঞ্জে নয়; পুরো কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন নদ-নদী আর খালে-বিলে কচুরিপানায় ভরপুর হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী কিংবা সরকারীভাবেও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ, দিনের পর দিন কচুরিপানার বিস্তার বাড়ছেই। গ্রাস করছে সমস্ত জলাশয়গুলো।

বলা বাহুল্য, কচুরিপানা চেনে না- এলাকার এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই যেখানে কচুরিপানা পৌঁছোয়নি। আজ থেকে শত শত বছর আগে ব্রাজিলের আমাজন নদীর অববাহিকা অঞ্চলে এই কচুরিপানার জন্ম হয়েছিল। পরে সে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেও অন্যান্য মহাদেশে তার একা একা পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু মানুষ ভুলল তার ফুলের রূপে। বেগুনি রঙের বাহারি ফুলের থোকা দেখে রূপমুগ্ধ মানুষ তাকে সযতেœ নিয়ে এসেছে নিজ নিজ দেশ বাংলাদেশে। ঠাঁই দিয়েছে বিশ্বের নামী বোটানিক্যাল গার্ডেনেও। কিন্তু কচুরিপানা যে রামায়ণের স্বর্ণমৃগের মতো রূপের আড়ালে কুচুটে মারীচ হয়ে উঠবে- তা যদি মানুষ জানত তবে এর নামই মুখে আনত না। কিন্ত সে আর বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুকুরে বা হ্রদে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাম ও শহরের সমস্ত পুকুর-ডোবা, জলাভূমি, খাল-বিল, নদী-হ্রদে পৌঁছে গেছে কচুরিপানা। অথচ, বাংলাদেশে কচুরিপানার আগমন বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯১৪ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে কেউ এই ভাসমান জলজ উদ্ভিদটিকে দেশে আমদানি করেছিল। উফ, কী ভুল যে করেছিল! মাত্র ৩৪/৩৫ বছর পরেই ১৯৫০ সাল নাগাদ এটি বাংলাদেশ-ভয়ঙ্কর আগাছা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এ থেকেই বোঝা যায় কী ভয়ানক গতিতে কচুরিপানা বংশবিস্তার করছে। আর তাই এর বর্ণনা দেওয়াও নিষ্প্রয়োজন। জলে ভেসে থাকার জন্য কচুরিপানার পাতার বৃন্ত ফোলা ও স্পঞ্জের মতো নরম হয়। এর মধ্যে বাতাস ভর্তি থাকে। ফলে কচুরিপানা জলে ভেসে থাকতে পারে। এদের বংশবিস্তার হয় প্রধানতঃ অঙ্গজ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ একটা কচুরিপানার কয়েকটা শাখা থেকেই আরও কয়েকটা কচুরিপানার জন্ম হয়। তবে কচুরিপানার বীজ থেকেও বংশবিস্তার হয়। এক একটা কচুরিপানা থেকে কয়েক হাজার বীজ উৎপন্ন হয়, আর সেই বীজগুলো ২৮ বছর পরেও অঙ্কুরিত হতে পারে। দ্রæততম বংশবিস্তার করার ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হল কচুরিপানা। কেউ যদি আজকে দেখেন কোনও খালে-বিলে বা ডোবা-পুকুরের অর্ধেক কচুরিপানায় ভরা, তবে দু’সপ্তাহ পরে গিয়ে দেখবে, পুরো পুকুর ভরে গেছে।

বলা বাহুল্য, পন্টেডেরিয়াসি গোত্রের এই উদ্ভিদের ইংরেজি নাম ওয়াটার হায়াসিন্থ (ডধঃবৎ যুধপরহঃয)। বিজ্ঞানসম্মত নাম ঊরপযযড়ৎহরধ পৎধংংরঢ়বং. কচুরিপানা জলে জন্মায়- এটা আমরা সবাই জানি, তবে জল শুকিয়ে গেলেও এটা ভেজা মাটির উপর বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে। এক একটা কচুরিপানার উচ্চতা সাধারণতঃ এক ফুটের মধ্যেই থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। কচুরিপানা খাদ্য হিসেবে তৃণভোজী প্রাণীদের কাছে গ্রহণীয় নয়, কারণ এতে একরকম ধাতব কেলাস থাকে- যা ত্বকের আবরণী কলায় গেঁথে গিয়ে চুলকানির কারণ হয়। এই কেলাস হল ক্যালসিয়াম অক্সালেট দিয়ে তৈরি। এছাড়া এতে হাইড্রোজেন সায়ানাইড, উপার ও টার্পিনয়েড থাকে।

তবে আজকাল জৈব গ্যাস উৎপাদনের জন্য কিছু কচুরিপানা ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া ক্ষতিকর ধাতু সিসা, পারদ ও স্ট্রনশিয়াম-৯০ এবং কিছু ক্ষতিকর জৈব পদার্থকে কচুরিপানার মূল খুব ভালো শোষণ করে নেয়।

গবেষনার সুত্র থেকে দেখা গেছে, কচুরিপানা জল থেকে নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে শোষণ করে। আর তাই বর্জ্য জল প্রক্রিয়াকরণে কচুরিপানা ব্যবহৃত হতেই পারে। কিন্তু এই উপকারের তুলনায় অপকারের পরিমাণ বহুগুণ বেশি। প্রথমতঃ এরা দ্রæত বংশবিস্তার করে পুকুর, ডোবা, খাল-বিল, নদী, হ্রদ-কে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলে। এই কচুরিপানার কারণে আজ লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার ডাকাতিয়া নদী, নদনার খাল, গাঘৈর খাল ও মেল্লার খাল মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। নৌ-যোগাযোগ উপরন্ত এলাকাবাসীর মৎস্য শিকার সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে এলাকার প্রায় সমস্ত জলাশয় কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। এতে পানি প্রবাহে সমস্যা হচ্ছে। যার ফলশ্রæতিতে হাট-বাজারে আর শহর-বন্দরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ, কচুরিপানা পঁচে গিয়ে পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহারের অযোগ্য। এই পানিতে চাষবাস, মাছ চাষ বা গৃহস্থালীর কাজ করাও সম্ভব নয়।

তৃতীয়তঃ, কচুরিপানাপূর্ণ জলাশয় হল কিউলেক্স ও এডিস মশার আঁতুড় ঘর। ফলে ডেঙ্গু, এনকেফালাইটিস, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি মশাবাহিত রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এছাড়া, কচুরিপানা হলো একপ্রকার শামুকের প্রিয় বাসস্থান। এই শামুক সিস্টোসোমিয়াসিস নামক একপ্রকার কৃমিঘটিত রোগ ছড়ায়। চতুর্থতঃ, কচুরিপানাপূর্ণ জলাশয়ের জলে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না বলে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনসহ জলের অন্যান্য উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। আবার জলে অক্সিজেনেরও অভাব হয়। ফলে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। সামগ্রিকভাবে কচুরিপানার জন্য ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলের বাস্তুতন্ত্র। পঞ্চমতঃ, কচুরিপানা প্রচুর পরিমাণে জল বাষ্পমোচন করে। ফলে জলাশয়ের জল দ্রæত শুকিয়ে যায়। ষষ্ঠতঃ, কচুরিপানা ক্রমাগত পঁচে গিয়ে জলাশয়ের তলদেশ ভরাট করে দিতে থাকে। সপ্তমতঃ, নদীতে ভাসমান কচুরিপানা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে টারবাইনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে।

তাহলে এই কুচুটে কচুরিপানাদের নিধনের উপায় কী? হাতে টেনে তুলে এ যদুবংশকে নির্বংশ করা কার্যত অসম্ভব। বর্তমানে কচুরিপানা দমন করার জন্য প্রচলিত তিনটি রাসায়নিক হল ২-৪ ডি, ডাইকোয়াট এবং গ্লাইফোসেট। ২-৪ ডি প্রয়োগের দু’সপ্তাহের মধ্যে সব কচুরিপানা মরে যায়। ডাইকোয়াট-ও (তরল ব্রোমাইড লবন) দ্রæত কাজ করে। তবে গ্লাইফোসেট দিয়ে কচুরিপানাকে ধ্বংস করতে প্রায় তিন সপ্তাহ লেগে যায়। রাসায়নিক প্রয়োগে কচুরিপানা দমন করা যেমন ব্যয়বহুল তেমনই পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই বিজ্ঞানীরা জৈব নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারেই বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছেন। কচুরিপানাকে খাদ্য হিসেবে পছন্দ করে এমন তিনটি পতঙ্গের সন্ধান মিলেছে কিন্তু তারা যে গতিতে কচুরিপানাকে খায় তার চেয়ে দ্রæতগতিতে কচুরিপানা বংশবিস্তার করে। তাই জৈব নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারীভাবে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। অথচ, এই সর্বনাশা আগাছার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন থেকে। এদের নির্বংশ করার জন্য বিজ্ঞানীরা উদয়াস্ত গবেষণায় ডুবে থাকলেও বাস্তবে কোনো কোনো সুফল দেখা যাচ্ছেনা। অথচ, কচুরিপানা শুধু পানি আঁকড়ে পড়ে আছে শুধু নয়; গিলে খাচ্ছে দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশ। তাই আপাততঃ এই কচুরিপানা ধ্বংস এবং এর সর্বনাশ থেকে সকলকে রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের একটি বড় দাবী।

Share This

COMMENTS