বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ ভ‚মি লাকসাম উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যালয় এখন ভ‚তের বাড়ী


ষ্টাফ রিপোর্টার\ বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতি ছিলো শিক্ষকদের দাবী আদায়ের একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সংগঠন। বর্তমানে এ সংগঠনটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রাথমিক শিক্ষকদের সমস্যা নিরসনের পরিবর্তে সংগঠনগুলো আত্মকোলাহলে নিমজ্জিত।
দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলায় বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ভবনটি আজ ভ‚তের ঘরে পরিনত হয়েছে। উপরন্তু প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রায় ৬০ শতক জমি যেকোন সময়ে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
একসময় শিক্ষকদের নিয়মিত পদচারণা ছিলো সমিতির কার্যালয়ে। মুখরিত ছিল শিক্ষকদের হলরুম। দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে নিয়মিত পদচারণ না থাকায় ও কার্যক্রম বিলুপ্ত হওয়ায় এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অযতœ, অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষক সমিতির নামে কোটি টাকার এ সম্পদ। এসব নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
জানা গেছে, এক সময় প্রশাসনিকভাবে বৃহত্তর লাকসামের একটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কুমিল্লা জেলার দক্ষিনাঞ্চলের নাঙ্গলকোট, সদর দক্ষিণ, মনোহরগঞ্জ ও লালমাই নিয়ে গঠিত ছিল বৃহত্তর লাকসাম উপজেলা। নের্তৃত্ব ও শাসন লাকসাম থেকেই পরিচালিত হতো। ১৯৭৩ সালে লাকসাম পৌর শহরের নশরতপুর এলাকায় বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নামে প্রায় ৬০ শতক জমির উপর গড়ে তোলা হয় লাকসাম উপজেলা কার্যালয়। এতে রয়েছে একটি দ্বি-তল ভবন, হলরুম ও পাকা ঘাটলাসহ পুকুর। ভবনগুলোতে সংযোগ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন, ছিল কয়েকটি ফ্যান এবং অনেক মূল্যমাণ আসবাবপত্র।
লাকসাম উপজেলা কার্যালয়টি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন, নশরতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান, সাধারন সম্পাদক ছিলেন, গাজিমুড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা আলী আশ্রাফ। ২০০০ সাল পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৮ সালে নানা জটিলতায় শিক্ষক সমিতির নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরে ২০১২ সালে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতি পদে নশরতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিকাশ সিনহা ও সাধারণ সম্পাদক পদে গাজিমুড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শাহ আলম মজুমদার নির্বাচিত হন। তাদের বিতর্কিত কার্যক্রমে সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। পরবর্তীতে সমিতির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেইন গেটের সামনে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি লাকসাম উপজেলা শাখা কার্যালয়।’ ভিতরে গিয়ে দেখা মিলে শিক্ষকদের হলরুমের বারান্দায় কয়েকটি ছাগলের বসবাস। পুরোটাই ঝোপ-জঙ্গল, ময়লা-আবর্জনায় ভরা। দোতলা এ ভবনটির নিচতলার কয়েকটি রুমের জানালার কাচ ভেঙে গেছে। রডগুলোতে ভেজা কাপড় ঝুলিয়ে শুকাচ্ছেন অস্থায়ী এক পরিবার। অযতেœ-অবহেলায় ভবনের চারপাশের বড় বড় বিভিন্ন প্রজাতির গাছে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে দ্বিতল ভবনটি। সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে বৃষ্টির পানিতে ভবনের দেয়াল ও প্রাচীরগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভবনের সামনে রয়েছে পাকা ঘাটলাসহ একটি পুকুর। ঘাটলাটি ২ ভাগে ফাটল হয়ে পড়ে আছে পুকুরে ভিতরে। হঠাৎ যে কারও দেখে মনে হবে শিক্ষক সমিতি নয়; যেন ভূতের আস্তানা। বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির কার্যালয়। তবে কার্যালয়টি দেখাশোনার জন্য ২০১৪ সালে কামাল হোসেন নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তার পরিবার নিয়ে দ্বিতীয় তলা ভবনে বসবাস করছেন। বর্তমান কামাল হোসেন না থাকলেও তার মা ভাই-বোন থাকছে ভবনটিতে।
কথা হয় কামাল হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, কার্যালয়ে সামনে আমার মিষ্টির ঢুংগা বানানোর কারখানা থাকার কারনে আমি বাবা মা ভাই বোন নিয়ে সমিতির লোকজন সাথে কথা বলে কার্যালয়ে উঠেছি। এখন পরিবার নিয়ে অশ্বতলায় এলাকায় থাকছি। ভবনটির বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল আমি নিজেই পরিশোধ করছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলেন, দ্বিতীয় তলা ভবনের পিছনে ঝাড়-জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া যে অবস্থা রাত হলেই শিয়াল, কুকুর, বিষাক্ত সাপ আর বিড়ালের ডাক শোনা যায়। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিক্ষক হলরুমের ভেতরে থাকা আসবাবপত্র ও ফার্নিচার। ধুলো আর ময়লা ছাড়া তিল ধারণের জায়গাটিও যেন নেই হল রুমের ভেতরে। একজন ব্যবসায়ী তার পরিবার নিয়ে থাকছে ঝুঁকিপূর্ন ভবনে এমনকি শিক্ষকদের হলরুমে ছাগলের খামার করছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির লাকসাম শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এলাইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ জাহান বলেন, সংগঠন বিলুপ্তি হওয়ার কারণে এখন আর কেউ প্রতিষ্ঠানটির খোঁজ খবর নিচ্ছেনা। বর্তমানে কার্যালয়টি পরিত্যক্ত হিসাবে পড়ে রয়েছে। সমিতির কার্যালয়ে দেখা শোনার জন্য একজন ব্যবসায়ী তার পরিবার নিয়ে থাকছেন এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল নিজ অর্থায়নে তিনি পরিশোধ করছেন। তবে খুব শীঘ্রই সমিতির কমিটি গঠন করে আবারো কার্যক্রম সচল হবে বলে তিনি জানান।
কামরুল হাসান নামে এক শিক্ষক বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি সংগঠন বা সমিতি। এই সমিতি শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, শিক্ষকদের অধিকার আদায়, শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে। শিক্ষকদের এ সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন দাবি দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরে এবং তাদের পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করে। শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। বর্তমানে লাকসাম উপজেলা শিক্ষক সমিতির কার্যালয়টি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে। সমিতির কার্যক্রম না থাকায় এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে শিক্ষকদের কোটি টাকার সম্পদ।
এ ব্যাপারে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাউছার হামিদ বলেন, লাকসামে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নামে যে কার্যালয়টি রয়েছে সেটি আমার জানা নেই। তবে সম্পত্তি ও ভবনগুলোর বিষয়ে দ্রæত খোঁজ-খবর নিবো।