বৃহস্পতিবার, ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের দিক-নির্দেশনা

বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের দিক-নির্দেশনা
২৪ Views

           মোঃ আবদুল হান্নানঃ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বৈষম্য একটি সামাজিক ব্যাধি। বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থান কিংবা সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে মানুষকে আলাদা করা, ছোট করা কিংবা অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই বৈষম্য।

            আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পরও বৈষম্য আজও বিদ্যমান। সে বৈষম্য কখনো ধনী-গরীবের ব্যবধান হিসেবে, কখনো নারী-পুরুষ বৈষম্য হিসেবে, আবার কখনো বর্ণবাদ ও জাতিগত বিদ্বেষের মাধ্যমে। বৈষম্য মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করে, সমাজে অশান্তি, শোষণ ও অবিচার জন্ম দেয়। অন্যদিকে, ইসলাম এসেছে মানবতার জন্য একটি সর্বজনীন কল্যাণকর দাওয়াত নিয়ে, যার মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে একটি সমাজ গড়ে তোলা। কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান; কেবল তাকওয়া বা ঈমানের গুণেই মর্যাদা লাভ করা যায়। মানবজাতি মূলত এক পরিবারÑআদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। তাই মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা ইসলাম অনুমোদন করে

না। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ “হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, যে অধিক তাকওয়াশীল।

            নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিজ্ঞ।” (আল-কুরআন, ৪৯:১৩) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়Ñমানুষের মধ্যে বিভাজনের উদ্দেশ্য শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং পারস্পরিক পরিচয় ও সহযোগিতা। মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি তাকওয়া।

            এটি ইসলামী সমাজব্যবস্থার ভিত্তি। কোনো মানুষ ধনী, প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান হওয়ার কারণে আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ নয়। কুরআনে মুসলিম সমাজকে এক শরীরের মতো গণ্য করা হয়েছে। “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (আল-কুরআন, ৩:১০৩) এই আয়াত মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ঘোষণা। বিভক্তি ও বৈষম্য ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী।

            রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বিদায়ী হজ্জ্বের খুতবায় মানবসমাজের জন্য এক অনন্য ঘোষণা দেন, যা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের মৌলিক ভিত্তি। তিনি বলেনÑ “হে মানবজাতি! জেনে রাখ, তোমাদের রব একজন এবং তোমাদের পিতা একজন। কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আবার কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই; কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আবার কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই; কেবল তাকওয়ার মাধ্যমেই মর্যাদা নির্ধারিত হয়।” (মুসনাদ আহমাদ) এই হাদীস ইসলামী সমাজব্যবস্থার মূল আদর্শকে প্রকাশ করেÑযেখানে বর্ণ, ভাষা, জাতি, গোত্র কিংবা ধন-সম্পদ কোনো পার্থক্যের কারণ নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই ঘোষণা ইসলামী সমাজব্যবস্থার মূলমন্ত্র। উদাহরণস্বরূপ: মক্কা থেকে হিজরত করার পর মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম যে কাজ করেন তা হলো মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে দুই শ্রেণিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। হাদীসে এসেছেÑ “নবী (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এবং সা‘দ ইবনে রাবী‘

(রা.)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন।” (সহীহ বুখারী) এভাবে রাসূল (সা.) ধনী-গরীব, মক্কার অভিবাসী ও মদীনার স্থানীয়দের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া ইসলামের পূর্বে দাসপ্রথা ছিল বৈষম্যের বড় উৎস।

            রাসূলুল্লাহ (সা.) দাসমুক্তিকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অংশ করেছেন। দাসমুক্তিকে তিনি পাপের কাফফারা, যুদ্ধে বন্দিদের মুক্তি এবং সদকার উত্তম পথ হিসেবে ঘোষণা করেন। কুরআনে আল্লাহ বলেনÑ “একজন দাস মুক্ত করা।” (আল-কুরআন, ৯০:১৩) রাসূল (সা.) বলেছেনÑ “যে কোনো মুসলিম দাসকে মুক্ত করবে, আল্লাহ তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে তার একটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।” (সহীহ মুসলিম)। এভাবে ইসলাম ধাপে ধাপে দাসপ্রথার অবসান ঘটায়।

            জাহেলী যুগে নারীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তাঁদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো, তাঁদের মতামতকে মূল্য দেয়া হতো না। ইসলাম এসে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

রাসূল (সা.) বলেছেনÑ “নারীরা পুরুষদের সমগোত্রীয় (অর্ধাংশ)।” (সুনান আবি াউ) আল-কুরআনে আল্লাহ বলেনÑ “আর নারীদের রয়েছে বিধি মোতাবেক অধিকার। যেমন আছে তাদের উপর (পুরুষদের) অধিকার।”

(আল-কুরআন, ২:২২৮) এভাবে ইসলাম নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করে মানবসমাজে সমান মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিচারকার্যে কখনো বৈষম্য করেননি। ধনী-গরীব, প্রভাবশালী-সাধারণÑসবার জন্য আইন সমান ছিল। একবার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী চুরির অপরাধ করলে কিছু সাহাবী তাঁর জন্য সুপারিশ করতে চাইলে নবী (সা.) রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেনÑ“তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছিল এ কারণে যে, তারা যখন কোনো

প্রভাবশালী ব্যক্তি চুরি করত তাকে ছেড়ে দিত, আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করত।

            আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, আমি তাঁর হাত কেটে দিতাম।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামে বিচারব্যবস্থায় বৈষম্যের কোনো স্থান নেই।

রাসূল (সা.) বারবার দুর্বল শ্রেণির প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনÑ “তোমরা কি দুর্বলের কারণে বিজয়ী ও রিজিকপ্রাপ্ত হচ্ছ না?” (সহীহ বুখারী) অতএব, সমাজে যারা দুর্বল, গরীব বা নিপীড়িতÑতাদের জন্য সুবিচার ও সুযোগ নিশ্চিত করাই রাসূল (সা.)-এর শিক্ষা।

            সর্বোপরি, ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে।

            কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম শুধু তাত্তি¡ক নীতি নয়, বরং বাস্তব জীবনে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। ইসলাম ধনী-গরীব, পুরুষ-নারী, আরব-অনারব বা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মর্যাদা সমান ঘোষণা করেছে। ন্যায়পরায়ণতা, তাকওয়া, দয়া, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতা ইসলামের এমন মূল নীতি যা সমাজে নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার ভিত্তি স্থাপন করে। রাসূল (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীন যুগে এ নীতির বাস্তব রূপ লক্ষ্য করা যায়Ñমুহাজির-আনসারের ভ্রাতৃত্ব, মদিনার সনদ, বায়তুল মাল থেকে সমান অর্থ বণ্টন, এবং সবার জন্য সমান বিচার ব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বের সংকটপূর্ণ সামাজিক পেক্ষ্রাপটে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নারীর প্রতি বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য ইত্যাদি যাবতীয় বৈষম্য সমাধান দিতে সক্ষম শুধু ইসলামী জীবনব্যবস্থার মাধ্যমে। ইসলামী নীতি অনুসরণ করে আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক, দারিদ্র্যহীন, নৈতিক ও মানবিক সমাজ গড়ে

তুলতে পারি।

            সুতরাং আমাদের করণীয় হলো, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিক নীতি যেমন জাকাত, সদকা, ওয়াকফ এবং সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা আধুনিক সমাজে প্রয়োগ করতে হবে; পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক সমতা, নারীর অধিকার এবং মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে; রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সকলের জন্য সমান বিচার ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং দরিদ্র, এতিম ও অভাবী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন; এছাড়া সমাজের প্রতিটি স্তরে সততা, দায়িত্বশীলতা, দয়া ও সহমর্মিতা প্রচার করতে হবে; বিশ্ব মানবতার কল্যাণে ইসলামের নৈতিক ও সামাজিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো উচিত; এবং সকল সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখকঃ অধ্যক্ষ, দৌলতগঞ্জ গাজীমুড়া কামিল মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।

Share This