শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভোট প্রয়োগ নিয়ে ইসলাম যা বলে!

ভোট প্রয়োগ নিয়ে ইসলাম যা বলে!

ডেক্স নিউজ\ ভোট হলো ইসলামের দৃষ্টিতে একটি পবিত্র আমানত। এটি একজন নাগরিকের অধিকারও বটে। একজন মুসলমান কখনও এ অধিকারের খেয়ানত করতে পারেন না। ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে সকল নাগরিককে হতে হবে দায়িত্বশীল। বিশেষ করে একজন মুসলিম নাগরিককে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে প্রধান্য দিতে হবে। টাকার বিনিময়ে ভোট দেওয়া যাবে না। অন্যান্য চুরির ন্যায় ভোট চুরি করাও একটি গুরুতর অপরাধ। জাল ভোট প্রদান ও অন্যকে ভোট প্রদানে বাধা প্রদানকারী হাক্কুল ইবাদ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে। একজন মুসলমান নিজে অন্যায় করবেন না এবং অন্যকে অন্যায় করার সুযোগ দেবেন না।
বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতায় শতভাগ ভালো মানুষ পাওয়া অনেক কঠিন। তারপরেও ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, হক ও বাতিল, ঈমান ও কুফর, সুন্দর ও অসুন্দরের পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনার ভোট হতে পারে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কল্যাণ ও অকল্যাণের এ মিশ্রিত সময়ে অপেক্ষাকৃত তুলনামূলক সৎ, ভালো ও ইসলামপন্থী মজলুম মানুষগুলো হতে পারে আপনার সমবেদনার আশ্রয়স্থল। ভোটের মাধ্যমে ইসলাম যে কেবল দোয়া দুরূদের মন্ত্র নয়, ইসলামে যে একটি শাসনতন্ত্র ও তার রাষ্ট্রীয় দর্শন রয়েছে এটির প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
ভোটের ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নে উল্লেখ করা হলো;
আসলে ভোট হলো একটি সুপারিশ। আপনার সুপারিশটি যেন সুন্দর ও বাস্তবধর্মী হয়। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কেউ কোনো ভালো কাজে সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ রয়েছে, আর কেউ মন্দ কাজে সুপারিশ করলে তাতেও তার অংশ রয়েছে।’ (সূরা নিসা আয়াত নং ৮৫)।
আর ভোট একটি সাক্ষ্যও বটে! মহানবী (সা.) বলেছেন- মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া কবিরা গোনাহ। সুতরাং একজন ভোটার হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন সাক্ষীদাতা।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো। আল্লাহর ওয়াসতে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য প্রদর্শন করো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ্ই শুভাকাঙ্খী তোমাদের চেয়ে। সুতরাং তোমরা বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হইও না। যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কেটে যাও তবে তোমরা যা করছো আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা, ৪: ১৩৫)।
ভোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবেও গণ্য। ভোটে হারজিত থাকবেই। এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা মুমিনের দায়িত্ব। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তুমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাতের অথবা মুখের অথবা অন্তরের সাহায্যে লড়াই কর। (মিশকাত, পৃষ্ঠা-৪৩৬)।
ভোট জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের রায় বলেও মনে করা হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তুমি সাহায্য কর, তোমার ভাইকে সে যদি জালিম কিংবা মজলুমও হয়। এর ব্যাখ্যায় মহানবী (সা.) নিজেই বলেন, জালিমকে সাহায্য দানের অর্থ হলো জুলুম থেকে নিবৃত্ত রাখা। তাই ভোট হতে পারে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে একটি নিরব প্রতিবাদ।
ভোট একটি দাওয়াত বলেও মনে করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা এমন একটি দল, মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে। মারুফ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। এতেই তোমরা সফল হতে পারবে। সুতরাং ইসলাম ও মুসলমানের দিকে আহবানের ক্ষেত্রে ভোট একটি কৌশলগত দাওয়াত।
মূলত: ভোট হলো ঐক্যের সোপান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ঐক্যবদ্ব্যভাবে আমার রুজ্জুকে ধরে রাখ এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আল- ইমরান)। অন্যৈক্যের কারণেই আজ মুসলমানদের বিপর্যয়। আমরা হতাশ হই যখন দেখি ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও প্রবল বিরোধ। এক্ষেত্রে ইখতিলাফ মাআল ইত্বিহাদ নীতির ভিত্তিতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। নয়তো একসময় সকল ইসলামি শক্তিই অসহায় হয়ে যাবে।
প্রকৃত পক্ষে ভোট একটি আমানত স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে পাকে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমানত তার হক্দারকে প্রত্যার্পণ করার জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। (সূরা নিসা) সুতরাং আপনি যাকে আপনার কাজের দায়িত্ব প্রদান করছেন তার ইচ্ছা ও যোগ্যতা উভয়ইটি দেখতে হবে।
ভোট হলো নেতা/প্রতিনিধি
নির্বাচনের কৌশল
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, আল্লাহ্ অবশ্যই তালুতকে তোমাদের রাজা করেছেন। তারা বললো, আমাদের উপর তার রাজত্ব কীরূপে হবে; যখন আমরা তার অপো রাজত্বের অধিক হক্দার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্য্য দেয়া হয়নি। নবী বললেন, আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাবান।’ (সূরা বাকারা ২৪৭)
এক কথায় ভোট হলো নাগরিকের সমর্থনের একটি মাধ্যম। আপনি কাকে সমর্থন করবেন? এটি ভোটের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোমানরা নিকটবর্তী নিম্ন ভূমিতে পরাজিত হয়েছিল। তাদের পরাজয়ের কয়েক বছরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার আদেশে আবার তারা বিজয়ী হবে। অগ্রপশ্চাত তারই হাতে। এতে মুমিনগণ আনন্দিত হবে। (সূরা রোম- ১-৪)
এ আয়াতের শানে নুযুল হচ্ছে মক্কী জীবনে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। রোমকরা কিছুটা আহলে কিতাবী হওয়ায় আবু বক্কর সিদ্দিক (রা.) এবং তার সতীর্থরা তাদের বিজয় কামনা করেছিলেন। অন্যদিকে আবু জাহেল গং পারসিকরা অগ্নি-পূজারি হওয়ায় তাদের জয় আশা করছিলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রথম দফা যুদ্ধে পারসিকরা জিতে গেল। এতে আবু জাহেল ও তার সমর্থকগণ উল্লাসিত হন এবং আবু বক্কর (রা.) ও তার বন্ধুরা ব্যথিত হন।
ভোট হলো নাগরিকের
মতামতের বহি:প্রকাশ
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আপনি কাজ কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। অতঃপর আপনি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। (সূরাআল ইমরান- ১৫৯) পরামর্শ করে কাজ করলে সে কাজের মধ্যে বরকত হয়। রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে সেক্ষেত্রে ভোটের মাধ্যমে নাগরিক তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারেন।
ভোট ও সাক্ষ্য হিসেবে- ভোটের মধ্যে যে তিনটি (সাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ, প্রতিনিধিত্বের সনদপ্রদান) বিষয় রয়েছে এর মধ্যে ‘শাহাদত’ বা সাক্ষ্যের বিষয়টি মৌলিক। অর্থাৎ কাউকে ভোট দেয়ার অর্থ হল, তার ব্যাপারে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ভালো এবং যোগ্য। এখন যদি যথাযথ জায়গায় সীল দিয়ে এ সাক্ষ্য প্রদান করা হয় তবে সে হবে সত্য সাক্ষী অন্যথায় হবে মিথ্যা সাক্ষী। আর মিথ্যা সাক্ষ্য যে কত বড় কবীরা গুনাহ ও হারাম কাজ তা কি কারো অজানা রয়েছে? অবশ্য বর্তমান বে-দ্বীনি ও বস্তুবাদিতার যুগে অনেকের কাছেই মিথ্যা কোনো বিষয়ই নয়। কথায়, লিখায়, ক্ষমতায়, আদালতে, বই-মিডিয়ায়, বক্তৃতা-ভাষণে সব জায়গাতেই মিথ্যার সয়লাব।
সুনানে তিরমিযীর একটি হাদিসে মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সমান অপরাধ বলা হয়েছে। সু-বিখ্যাত হাদীস বিশারদ শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. মিথ্যা সাক্ষ্যকে চারটি বড় গুনাহের সমষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে- ১. নিজে মিথ্যা ও অপবাদ আরোপ করছে। ২. যার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছে তার ওপর জুলুম করছে। ৩. যার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে তার উপরও প্রকৃতপক্ষে যুলুম করছে কারণ, সে যা কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিল না এ ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে তাকে এর অধিকারী করে তুলছে এবং এভাবে তাকে করছে জাহান্নামি। ৪. মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার একটি হালাল কাজকে হারাম বানিয়ে নেয়া। তবে ভোট অবশ্যই সকলকে দিতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনা পড়ে প্রশ্ন আসতে পারে যে, তা হলে তো বর্তমান সমাজে অধিকাংশ আসনের লোকদের ভোট দেয়াই সম্ভব হবে না। কারণ, এমন লোক তো পাওয়া যাবে না, যার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করা যায়। এ কারণে অনেকে ভোট দেয়া থেকে বিরতও থাকেন, এমনকি বহু লোক ভোটার হতেও আগ্রহী হন না। সাধারণ বিবেচনায় এ চিন্তা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এক্ষেত্রে কিন্তু মুদ্রার ভিন্ন পিঠও রয়েছে। তা হচ্ছে, মন্দের ভালো বা তুলনামূলক কম ক্ষতিকে বেছে নেয়া এবং অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করা।
বর্তমানে ভোটকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনায় আনতে হবে এবং ভোটের মাধ্যমে অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কোনো আসনে একজন লোককেও যদি সাক্ষ্য ও ভোট দেয়ার উপযুক্ত মনে না হয়, তবে তাদের মধ্যে যে জন নীতি-নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে অন্য প্রার্থীর তুলনায় কম খারাপ তাকেই ভোট দিতে হবে। কারও ব্যাপারে যদি খোদাদ্রোহিতা, ইসলাম-দুশমনী, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ-বিরোধী হওয়ার সুস্পষ্ট আলামত থাকে তবে ঐ অসৎ ব্যক্তির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে ভোটারাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে।
মোটকথা, গণতন্ত্র ও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির যতই ত্রুটি থাকুক এর কারণে ভোট দানে বিরত থাকা যথার্থ হবে না; বরং বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে, ভেবে-চিন্তে ভোটারাধিকার প্রয়োগ করতে হবে ভালো-মন্দের ভালো অথবা অন্তত কম মন্দের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে শরীয়তর দৃষ্টিতে কাউকে ভোটদানের অর্থ হবে, এ সাক্ষ্য দেয়া যে, লোকটি তার প্রতিদ্ব›িদ্বদের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো অবশ্যই। সুত্র: লালমনিরহাট বার্তা

Share This

COMMENTS