যুক্ত হলেন বিশ্বের দেড় হাজার বিজ্ঞানী! অস্তিত্ব’ অনুসন্ধান চলছে মাটির ১,৫০০ মিটার নীচে


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটার কুয়াশায় ঢাকা বনভূমির নীচে একটি আধুনিক গবেষণাগারে চলছে এক ঐতিহাসিক অনুসন্ধান। বিজ্ঞানীরা খুঁজে ফিরছেন এমন একটি প্রশ্নের উত্তর, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গভীর রহস্য; কেন এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব? এই প্রশ্নের সমাধান নিয়ে প্রতিযোগিতায় রয়েছে দুইটি গবেষণা দল— একটি যুক্তরাষ্ট্রের এবং অন্যটি জাপানের নেতৃত্বে। তবে জাপানি দল ইতিমধ্যেই কয়েক বছর এগিয়ে আছে। বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো এখনও বোঝাতে পারেনি কেন গ্রহ, নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সির মতো বস্তুগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। এই রহস্যভেদে বিজ্ঞানীরা এখন নজর দিয়েছেন এক অতি সূক্ষ্ম উপমাণু কণা— নিউট্রিনোর দিকে। এই কণাটির আচরণ বিশ্লেষণ করে উত্তর পাওয়ার আশায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান দুই দেশেই তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের ডিটেক্টর। মার্কিন বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন “ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো এক্সপেরিমেন্ট” বা ডিউন প্রকল্পে, যা একটি সুবিশাল ভূগর্ভস্থ গবেষণাগার। দক্ষিণ ডাকোটার মাটির প্রায় ১ হাজার ৫০০ মিটার নিচে তিনটি বিরাট গুহায় এই প্রকল্পের কাজ চলছে।
এতটাই বিশাল এর পরিসর যে, সেখানে থাকা বুলডোজার ও নির্মাণযন্ত্রগুলোকেও ছোট খেলনার মতো দেখায়। প্রকল্পটির বিজ্ঞান পরিচালক ড. জ্যারেট হেইসে গত প্রায় এক দশক ধরে এই গুহা তৈরির কাজে যুক্ত। তাঁর ভাষায়, এই গুহাগুলো যেন “বিজ্ঞানের জন্য নির্মিত বিশাল গির্জা।” পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ থেকে আসা শব্দ ও বিকিরণ থেকে বিচ্ছিন্ন এই স্থানে এখন প্রস্তুত হচ্ছে মহাবিশ্বের গূঢ় সত্য জানার এক নতুন অধ্যায়। “আমরা এমন এক ডিটেক্টর নির্মাণে প্রস্তুত, যা আমাদের অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচনে নতুন পথ দেখাবে। এতে যুক্ত হচ্ছেন বিশ্বের ১ হাজার ৫০০ বিজ্ঞানী,” বলেন ড. হেইসে। তাত্ত্বিকভাবে, মহাবিশ্বের শুরুতে একই পরিমাণ পদার্থ (matter) ও তার বিপরীত শক্তি অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয়েছিল। এই দুটি কণার একে অপরকে নিঃশেষ করে ফেলার কথা, যাতে কিছুই অবশিষ্ট না থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা.. পদার্থরূপে— টিকে আছি। এই ভেদাভেদের কারণ অনুসন্ধানেই নিউট্রিনো ও এর বিপরীত কণা অ্যান্টি-নিউট্রিনোর দিকে নজর বিজ্ঞানীদের। গবেষণার অংশ হিসেবে নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর কণা ইলিনয়ের ভূগর্ভ থেকে ছোড়া হবে দক্ষিণ ডাকোটায় থাকা ডিটেক্টরের দিকে— যার দূরত্ব প্রায় ৮০০ মাইল। কারণ এই কণাগুলো চলার পথে সামান্য হলেও নিজেদের রূপ বদলায়। বিজ্ঞানীরা দেখতে চান, এই পরিবর্তনের ধরন কি নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর জন্য এক নয়? যদি না হয়, তবে তা হতে পারে পদার্থের টিকে থাকার রহস্যের চাবিকাঠি। ডিউন একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্প, যাতে ৩০টি দেশের ১ হাজার ৪০০ বিজ্ঞানী কাজ করছেন।
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড. কেট শ বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং সফটওয়্যার দক্ষতার এমন পর্যায়ে আছি যে, এত বড় প্রশ্নগুলোর সমাধানে আমরা সত্যিই অগ্রসর হতে পারছি। এটা এক দারুণ সময়।’ অন্যদিকে, ড. লিন্ডা ক্রেমোনেসি, যিনি লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং ডিউন প্রকল্পে যুক্ত, মনে করেন— যদিও জাপানি দল কিছুটা এগিয়ে আছে, তবে এখনো তাদের সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ নয়। তাঁর মতে, “একটা প্রতিযোগিতা তো আছেই, তবে হাইপার-কে প্রকল্পে এখনো এমন কিছু নেই যা নিশ্চিত করে বলবে নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর আচরণ আসলেই আলাদা।” এই প্রতিযোগিতার মাঝেও নিশ্চিত ফলাফল পেতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাই সময়ের শুরুতে কী ঘটেছিল, কীভাবে এই মহাবিশ্ব ও আমাদের অস্তিত্ব গড়ে উঠল— এই রহস্য এখনও রয়ে গেছে অমীমাংসিত।
জাপানের বিজ্ঞানীরা অন্যদিকে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন এক আলোকোজ্জ্বল গোলকাকৃতি যন্ত্রের ভেতর দিয়ে, যা দেখতে যেন বিজ্ঞানের জন্য নির্মিত এক অনন্য মন্দির। তাদের নতুন ডিটেক্টরটির নাম ‘হাইপার-কে (Hyper-K)’—এটি আগের সুপরিচিত ‘সুপার-কে (Super-K)’ ডিটেক্টরের বড় ও উন্নত সংস্করণ। এই জাপানি নেতৃত্বাধীন প্রকল্পও একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দুই বছরের মধ্যেই তারা নিউট্রিনো বিম চালু করতে পারবে— যা ডিউনের চেয়ে অনেক আগে। লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের ড. মার্ক স্কট, যিনি হাইপার-কে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, বলেন, ‘আমরা আগে চালু করব এবং আমাদের ডিটেক্টর আরও বড়, ফলে ডিউনের চেয়ে আগে আমরা ফল পেতে পারি।’ তাঁর মতে, দুই প্রকল্প একসঙ্গে চালু থাকলে একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এবং বোঝার পরিসর আরও গভীর হবে। তবুও তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আমি চাই, আমাদেরই হোক্- প্রথম আবিষ্কারের কৃতিত্ব!’Ref: BBC