শেখ হাসিনার বিচারের প্রথম দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার মামলায় তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য এক মাসের সময় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল একই সঙ্গে একই বিষয়ে আরেক মামলায় শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
সাবেক সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীদের এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হলো। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধে বিচারের কথা বলে আসছে।
গত সোমবার প্রথম দিনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা ছিলেন তার সহযোগী।’
পরে সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত সরকারের ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। আগামী দিনে যারা ফ্যাসিস্ট হতে চান, তাদের জন্য আজকের দিনটি এক শিক্ষার দিন। মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না।’
এজলাসকক্ষ কেমন ছিল, কী হয়েছে:
মূলত: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীসহ মামলার অভিযুক্তদের আনা উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। সাংবাদিকদের অনেকে আদালত ভবনের সামনে যেতে পারলেও সুনির্দিষ্ট পাশ ছাড়া এজলাসকক্ষে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
তার পরও আদালতকক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাবেক সরকারের ১৩ মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীকে প্রিজন ভ্যানে করে বিভিন্ন কারাগার থেকে আদালত অঙ্গনে আনা হয়। সকাল পৌনে ১১টার দিকে তাদের আদালতকক্ষে কাঠগড়ায় নেওয়া হয়।
নীচে কাঠের রেলিং আর ওপরে কাচ ঘেরা কাঠগড়ার ভেতরে চেয়ারে বসে আদালত কার্যক্রম শুনেছেন আসামিরা। আসামিদের মধ্যে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক খান, তৌফিক এলাহী চৌধুরী, গাজী গোলাম দস্তগীর, কামাল আহমেদ মজুমদার, শাজাহান খান, সাবেক সচিব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং জুনাইদ আহমেদ পলক কাঠগড়ায় ছিলেন।
তবে, শুধু দীপু মনিকে কাঠগড়ার বাইরের পাশে একটি চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। অন্য এক আসামি আব্দুর রাজ্জাক অন্য মামলায় রিমান্ডে থাকায় আজ তাকে হাজির করা হয়নি। সকাল ১১টায় বিচারকরা এজলাসে প্রবেশ করলে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।
আসামির আইনজীবী সরকারি দায়িত্ব পাবেন:
আদালতের শুরুতেই চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আসামিপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীর বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সমাজী সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ পাঁচজনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওই আদালতে এসেছিলেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতকে জানান, এহসানুল হক সমাজী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন এবং সে কারণে তিনি এখন আসামিদের পক্ষে দাঁড়ালে সেটি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। এ কারণে তিনি সমাজীকে শুনানি থেকে বিরত থাকার জন্য আদালতের মাধ্যমে অনুরোধ করেন।
সমাজী আদালতকে জানান যে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তখন তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলছেন এবং সরকারের দিক থেকে খুব শিগগিরই এটি জানানো হবে।’
তখন আদালত সমাজীর কাছে জানতে চান যে তিনি এখন কী করবেন। জবাবে সমাজী বলেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু জানেন না এবং সরকারের দিক থেকে এমন কিছু এলে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। ‘তার পরও চিফ প্রসিকিউটর যেহেতু বলছেন সে কারণে বিতর্ক এড়াতে ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আজ শুনানি করছি না।’
পরে আজিজুর রহমান নামের আরেকজন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে কথা বলবেন বলে জানান সমাজী। তবে তার আবেদন বিচারকরা হাতে না পাওয়ায় আজ তার বক্তব্য তিনি উপস্থাপন করেননি।
সময় চাইলেন চিফ প্রসিকিউটর:
এরপর জুলাই-আগস্টের ঘটনায় গণহত্যার মামলার প্রথমটি নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। এই মামলার একমাত্র আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেখানে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে সব মানবতাবিরোধী অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তিনি করেননি। আর উপস্থিত আসামিরা এসব অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করে গেছেন। গণহত্যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চেয়েছেন।’
তবে এসব অপরাধের বিচারিক প্রমাণ সংগ্রহে আরো সময়ের প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি আদালতের কাছে দুই মাসের সময় চান। আদালত এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন।
এরপর তাজুল ইসলাম দ্বিতীয় মামলায় শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্য এবং তার দলের নেতাসহ সাবেক কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উল্লেখ করে তদন্তের জন্য সময় চাইলে আদালত এক মাস সময় দেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ১৪ জনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রসিকিউশনের আবেদনে এই ১৪ জনের মধ্যে উপস্থিত ১৩ জনকে ‘গণহত্যা’ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।
শেখ হাসিনা কোথায়:
এ পর্যায়ে আদালত চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের কাছে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কী হলো জানতে চান। তাজুল ইসলাম আদালতকে জানান যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকে তারা জানতে পেয়েছেন যে- তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। সে জন্য এখন ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া চলছে। এরপর ভারতের সঙ্গে যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে সে অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে ভারতকে অনুরোধ জানাবে সরকার।
এর মধ্যে কাঠগড়া থেকে দুইবার সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার দাঁড়িয়ে ‘মাননীয় আদালত’ শব্দগুলো উচ্চারণ করলেও তা আদালতের দৃষ্টিতে আসেনি। কাছে থাকা একজন পুলিশ সদস্য এগিয়ে কামাল মজুমদারকে তার চেয়ারে বসিয়ে দেন।
মামলার কার্যক্রম শেষ হলে আদালত আসামিদের সঙ্গে তাদের স্বজন ও আইনজীবীদের সাক্ষাতের অনুমতি দেন। এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারসহ বিচারকরা এজলাস ছেড়ে যান।
পরে দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আবারও প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় গত আওয়ামী লীগ সরকারের ৯ জন মন্ত্রীসহ ১৩ জন আসামিকে।
উল্লেখ থাকে যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত জুলাই ও আগস্টের আন্দোলন সময় সংঘটিত ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করে এ আদালতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের কথা বলছে সরকার।
মূলত: গত ১৭ই অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হলো। Ref: bbc/ kalerkantho/ photo: collected