রবিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক ইঞ্জিন সংকটে যাত্রী সাধারনের ভোগান্তি

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক ইঞ্জিন  সংকটে যাত্রী সাধারনের ভোগান্তি
২৭ Views

            নাসির উদ্দিন রকি\ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) সংকট দেখা দিয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য প্রতিদিন যেখানে প্রয়োজন ১১৯টি ইঞ্জিন, সেখানে কার্যত মিলছে মাত্র ৭৫টি। ফলে একদিকে বিশ্রাম ও রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ না পেয়ে দ্রæত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইঞ্জিনগুলো। অন্যদিকে প্রতিদিন কোনও কোনও ট্রেন ছাড়ছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে। ইঞ্জিন-সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম-দোহাজারী, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, চট্টগ্রাম-কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি রেলপথে লোকাল ও মেইল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

            রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা জানান, একটি ইঞ্জিন ট্রিপ শেষ করার পর স্বাভাবিকভাবে ৪৫ মিনিট ফুয়েল ও মেইনটেনেন্স চেক, এরপর আরও ৪৫ মিনিট এলএম চেকিং এবং ৭২ ঘণ্টা পর ৬ ঘণ্টার পূর্ণ শাটডাউন রেখে পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা এখন আর মানা যাচ্ছে না। ফলে ইঞ্জিনগুলোর আয়ুষ্কাল দ্রæত ফুরিয়ে আসছে।

            চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ম্যানেজার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘পূর্বাঞ্চল ট্রেনে ইঞ্জিন-সংকট আছে। এ কারণে চট্টগ্রাম-সিলেট ও চট্টগ্রাম-জামালপুর রুটে ট্রেন ছাড়তে প্রায় সময়ই বিলম্ব হয়। অনেক সময় ট্রেনের যাত্রাও বাতিল করতে হয়। এতে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।’

            খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১লা আগস্ট চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কক্সবাজারগামী প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। ওই ট্রেনের টিকিট নেয়া যাত্রীরা যাত্রার দিন স্টেশনে আসার পর বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর যাত্রীরা স্টেশনে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা স্টেশন ম্যানেজারের দরজায় লাগানো নেমপ্লে­ট ও বেশ কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন।

            রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, ইঞ্জিন-সংকটের কারণে ট্রেনটির ওই দিন যাত্রা বাতিল করা হয়। অপরদিকে, ইঞ্জিন-সংকটের কারণে গত ২৪শে আগস্ট ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছার কথা ছিল রাত সাড়ে ৩টায়। সেই ট্রেন চট্টগ্রাম এসে পৌঁছে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট দেরিতে সকাল ৬টা ১০ মিনিটে। এ ট্রেনেরই প্রায় ১০০ যাত্রী চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে আরেকটি ট্রেনে করে পর্যটন শহর কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। এ জন্য আগেই টিকিট কেটেছিলেন তারা। কিন্তু মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন দেরিতে পৌঁছার কারণে তারা কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেন মিস করেন। চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছার পর কক্সবাজার ট্রেন মিস করা যাত্রীরা স্টেশন মাস্টার এবং স্টেশন ম্যানেজারের কার্যালয় এবং রেললাইনে বসে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীরা সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে দেয়। প্রায় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট পর্যন্ত আটকে রাখা হয় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন। পরবর্তীতে ট্রেন মিস করা যাত্রীদের কক্সবাজারগামী অন্য একটি ট্রেনে তুলে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

            রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তত্ত¡াবধায়ক (কারখানা) মোস্তাফিজুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ১১৯টির মতো ইঞ্জিন দরকার। কিন্তু এখন আমরা প্রতিদিন গড়ে ৭৫ থেকে ৭৬টি ইঞ্জিন পাই। এখন মালবাহী ট্রেন থেকে ইঞ্জিন এনে কোনোরকমে সামাল দেয়া হচ্ছে। একটা লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কারখানায় আসার পর ভালোভাবে মেরামত করে দেয়ার মতো সময়ও পাচ্ছি না। কারণ যাত্রী নিয়ে যে ট্রেনে লোকোমোটিভটা আসছে সেটা অন্য ট্রেনে দিতে হচ্ছে।’

            তিনি আরও জানান, পূর্বাঞ্চলে যাত্রীবাহী ট্রেনে যতগুলো ইঞ্জিন চলছে তার ৫০ শতাংশের বেশি আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ ২০ বছরের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। যে কারণে ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ত্রুটি বেশি দেখা দিচ্ছে।

            রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি কনটেইনার ও তেলবাহী ট্রেন চলাচলেও দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। প্রতিদিন যেখানে ১৩টি ইঞ্জিন দরকার, সেখানে মিলছে মাত্র ৫টি ইঞ্জিন। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে কনটেইনার পরিবহনের জন্য দরকার ৪টি ইঞ্জিন, অথচ মিলছে মাত্র একটি কিংবা দু’টি ইঞ্জিন। একই সমস্যা দেখা দিয়েছে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও। এছাড়া, রেলস্টেশন এবং শেডে ট্রেন শান্টিংয়ের জন্য যেখানে প্রতিদিন ১৩টি ইঞ্জিন দরকার, সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৪টি ইঞ্জিন।

            রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, ‘পূর্বাঞ্চল ট্রেনে যাত্রী এবং মালবাহী ট্রেনে ইঞ্জিন-সংকট আছে। প্রতিদিন মালবাহী ট্রেনে ১৩টি ইঞ্জিন দরকার। কিন্তু আমরা ৫ থেকে ৬টির বেশি দিতে পারছি না। যাত্রীবাহী ট্রেনের চাহিদা আছে, কিন্তু চালাতে পারছি না। ইঞ্জিন-সংকটের কারণে যাত্রী নিয়ে যে ইঞ্জিনটি শেডে আসছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে অন্য ট্রেনে যুক্ত করতে হচ্ছে। ভালোভাবে মেরামত করাও যাচ্ছে না। এ ছাড়াও মালবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন যাত্রীবাহী ট্রেনে যুক্ত করার ফলে ঠিকমতো মালবাহী ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।’

            রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘পূর্বাঞ্চল রেলে চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নেই। যেগুলো আছে সেগুলোকে যেটুকু সময় বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন তা দেয়া যাচ্ছে না। কেননা একটি ট্রেন ট্রিপ শেষ করে আসার পর ওই ইঞ্জিন আরেকটি ট্রেনে লাগানো হচ্ছে। এভাবেই চলছে ট্রেন। বিষয়টি রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা অবগত আছেন। ইঞ্জিন-সংকটের কারণে নতুন করে ট্রেন বাড়ানো যাচ্ছে না। ইঞ্জিনের চাহিদা দেয়া হয়েছে।’

Share This