নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের ত্রাহিদশা!


ষ্টাফ রিপোর্টার\ পণ্যমূল্য নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের কাচাবাজারগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের ত্রাহি অবস্থা। ব্যবসায়ীদের দাবি, টানা বৃষ্টির কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে সবজির দামে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কাঁচা মরিচে। কাঁচা মরিচের ঝালে যেন পুড়ছে বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৬০ টাকা দরে। ভোক্তাদের অভিযোগ সরকারের কার্যকর বাজার মনিটরিং না থাকায় অসৎ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি নিত্যপণ্যে দাম বেড়ে যাওয়ায় নি¤œআয় ও সীমিত আয়ের মানুষের সংসার চালানোর কঠিন হয়ে পড়ছে। বাজার করতে আসা অনেকেই প্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ধেক কিনে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি ও মাছের দাম বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহের তুলনায় বেশিরভাগ সবজির কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা বৃষ্টিতে ফলন নষ্ট হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, এটি কেবল ‘বাহানা’, সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন।
গত সোমবার লাকসাম ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের সবজির দামই বেড়েছে। বিশেষ করে, আগাম শীতকালীন সবজির বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার ওপরে, আর প্রতিকেজি কাঁচা মরিচের জন্য গুণতে হচ্ছে ৩০০ টাকার বেশি। অন্যদিকে দাম বেড়েছে মুরগি, ইলিশ ও অন্যান্য মাছের। বিক্রেতারা বলছেন, পূজার ছুটি ও বৃষ্টির কারণে বাজারে সবজির সরবরাহ কমায় দাম বাড়ছে।
সবজি বিক্রেতা আনিস বলেন, পূজার ছুটি ও গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে বাজারে দেশীয় সবজির সরবরাহও কিছুটা কম। সপ্তাহের ব্যবধানে অধিকাংশ সবজির দাম কেজিতে ১৫-২৫ টাকা করে বেড়েছে। আরেক বিক্রেতা শাহবুদ্দিন বলেন, বাড়তি দামের কারণে সবজি কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে ক্রেতারা। এতে বেচাবিক্রি অনেক কমে গেছে। ফলে দাম বেশি পেলেও লাভ হচ্ছে কম।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু ২৫-৩০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ২০-২৫ টাকা ছাড়া প্রায় সব ধরণের সবজির দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি শিম ১৫০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। ২০ টাকা বেড়ে মুলার দাম হয়েছে ৮০ টাকা। বর্তমানে টমেটো ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, গাজর ১৩০ টাকা, কচুর লতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা; পটল, চিচিঙ্গা ও কাঁকরোল ৮০ টাকা, বরবটি ও করলা ১০০ টাকা, লম্বা বেগুন ১০০ টাকা ও গোল বেগুন ১৪০ টাকা, উচ্চা করলা ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকা, যা আগে ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। লাউ ৮০ থেকে ১২০ টাকা এবং জালি লাউ ৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া মিষ্টি কুমড়া ও ধুন্দল ৬০-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও কাঁচা মরিচের দাম ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি। এখন তা ২৮০ থেকে ৩৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দৌলতগঞ্জ বাজারের বিক্রেতা আলী জানান, পাইকারি বাজারে মরিচের তীব্র সংকট চলছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিতে মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া, ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি বন্ধ আছে। এখন এক পাল্লা (পাঁচ কেজি) মরিচ কিনতেই ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা লাগে। এক সপ্তাহ আগেও তা ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
আরেক সবজি বিক্রেতা হোসেন জানান, পাইকারি বাজারে মরিচের সংকট তৈরি হয়েছে। বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়েছে, আবার ভারত থেকেও মরিচ আমদানি বন্ধ। ফলে ৫ কেজি মরিচ কিনতে হচ্ছে গত সপ্তাহের চেয়ে অনেক বেশি দামে।
ক্রেতারা বলছেন, আবারও লাগামছাড়া হচ্ছে সবজির দাম। চাপ বাড়ছে ভোক্তার। সবজি কিনতে আসা হাসান বলেন, বৃষ্টির অজুহাতে সবজির দাম কেজিতে ৩০ টাকার মতো বেড়ে গেছে। নতুন করে বাড়ছে কাঁচা মরিচের দাম। মরিচ গত সপ্তাহের চেয়ে অন্তত কেজিতে ১৫০ টাকা বেড়েছে। বাজারে এই অবস্থায় চাপ বাড়ছে মধ্যবিত্তের পকেটে।
আরেক ক্রেতা বাচ্চু বলেন, বাজার লাগাম ছাড়া হয়ে উঠেছে। সবজিতে হাতই দেয়া যাচ্ছে না। এটি নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য চাপ তৈরি করছে। বাজারের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে; না হলে ভোক্তার কষ্ট আরো বাড়বে।
এদিকে সবজির পাশাপাশি লাগামহীন হচ্ছে শাকের দাম। প্রতি আঁটি পুঁইশাক ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কুমড়া শাক ৫০ থেকে ৬০ টাকা, লালশাক ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কলমি শাক ২০ টাকা, পালং শাক ৪০ টাকা; পাট শাক, কচু শাক ও ডাঁটা শাক ৩০ টাকা এবং মুলা শাক ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবুজ নামে এক ব্যবসায়ী জানান, গত সপ্তাহে যে শাকের বস্তা ৩ হাজার টাকায় কিনেছি, এখন সেটি ৫ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে শাক নষ্ট হয়েছে। সরবরাহ কম থাকায় দাম চড়ছে। আগে গাড়ি ভর্তি করে আনতাম, এখন অল্প আনতে হচ্ছে। অনেক ক্রেতা দাম শুনেই ফিরে যাচ্ছেন।
সবজি ছাড়াও মাছের বাজারেও আগুন। গত শনিবার থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাছের রাজা। বড় ইলিশ ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি ইলিশ ২ হাজার এবং ছোট ইলিশ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য মাছের দাম রয়েছে আগের মতোই চড়া। প্রতিকেজি বোয়াল ৭৫০-৯০০ টাকা, কোরাল ৮০০-৮৫০ টাকা, আইড় ৭০০-৮০০ টাকা, চাষের রুই ৩০০-৪৫০ টাকা, কাতল ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৮০ টাকা, পাঙাশ ২০০ টাকা এবং পাবদা ও শিং ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চাষের ট্যাংরা ৭৫০-৮০০, কাঁচকি ৬৫০-৭০০ এবং মলা ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে বেড়েছে মুরগির দামও। কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। আর প্রতিকেজি সোনালি মুরগির জন্য গুনতে হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকা। তবে গরু ও খাসির গোশতের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজি গরুর গোশত ৭৬০-৮০০ টাকা, খাসির গোশত এক হাজার ২০০ টাকা ও ছাগলের গোশত এক হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশি হাঁস ৬০০-৬৫০, রাজহাঁস এক হাজার ৬০০- দুই হাজার এবং চায়না হাঁস এক হাজার ২০০- এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় বাজারে মানভেদে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, মাছ ও মাংসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একই সময়ে পেঁয়াজ, রসুন ও ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি সব ধরনের শাক-সবজির দাম বেশি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজারে প্রতি কেজি চিকন চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গতবছর আগে একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৬৪ থেকে ৮০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজি চিকন চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে মাঝারি মানের চাল কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, বাজারে প্রতি কেজি বড় দানার মসুর ডাল ৯৫ থেকে ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর এ সময়ে যার দাম ছিল ১০৫ থেকে ১১০ টাকা। মাঝারি মানের মসুর ডাল প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর একই সময়ে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া যেত। ছোট দানার মসুর ডালের কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে গতবছরের তুলনায় অ্যাংকর ডালের কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে বলে তথ্য দিচ্ছে টিসিবি। প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল ৬০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
আটা ও ময়দার মধ্যে খোলা আটা কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫২ টাকায়। যা গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। খোলা ময়দা কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেট আটা কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট ময়দার কেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। যা গত বছর এ সময়ে ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা।
আলোচ্য সময়ে ভোজ্যতেলের মধ্যে সব ধরনের তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৮ টাকায়। যা গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ১৫১ থেকে ১৫৫ টাকায়। এ হিসাবে প্রতি লিটার খোলা তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ থেকে ২৩ টাকা। আর বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৮ থেকে ১৯০ টাকায়। যা গত বছর ছিল ১৬৭ টাকা বা তারও কম। আর বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৯০ থেকে ৯২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া খোলা পাম অয়েলের লিটারে ১৬ থেকে ১৮ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫৩ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুপার পাম অয়েলের লিটারে ১০ থেকে ১৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫৫ থেকে ১৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর রাইস ব্রান তেলের ৫ লিটার গত বছর যেখানে ৯০০ টাকায় পাওয়া যেত এখন সেই তেল কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০ টাকা বা তারও বেশি দামে।