মনোহরগঞ্জের কমলপুর গ্রামে ৮০০ বছর পূর্বে ঐতিহাসিক ‘রাখাল রাজা’ স্মৃতিচিহ্ন


এম.এ মান্নান\ ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। সে সময় জমিদারদের ছিল প্রচন্ড প্রতাপও ছিলে। এখন সে প্রথা নেই, কিন্তু আছে জমিদারদের রেখে যাওয়া পরিত্যক্ত স্মৃতিচিহ্ন। ইট-সুরকির ভগ্নস্তূপের দিকে তাকালে অতীত টের পাওয়া যায়। একসময় জৌলশ ছিল, প্রাণের স্ফুরণ ছিল, আজ কিছুই নেই। জমিদারবাড়িটির সামনে দাঁড়ালে এমন অনুভূতি হতে পারে আপনার।
কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের কমলপুর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৮শ’ বছর আগের এমন একটি স্মৃতিচিহ্ন যা ‘রাখাল রাজা’ জমিদারবাড়ি নামে পরিচিত। জমিদার রাখাল রাজা ছিলেন অত্যাচারী জমিদার, রাজার নির্মাণের এ বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এ বাড়িটি। সংস্কারের অভাবে এ বাড়িটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেই জমিদার রাখাল রাজা রাজত্ব এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ঐতিহাসিক প্রাচীন এ স্থাপনাটি অযতœ, অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে জৌলুস হারিয়েছে অনেক আগেই। কারুকার্য খচিত জরাজীর্ণ বাসভবন, বৈঠকখানা, শিব মন্দিরের দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠছে লতাপাতা। এখানকার আশেপাশে তেমন কোথাও দর্শনীয় স্থান না থাকায় প্রাচীন এ বাড়িটি একনজর দেখতে এখনও বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। কেউ টিক টক ভিডিও করছেন, কেউবা প্রিয়জনদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। আবার কেউবা মাদক সেবনের জন্য গোপনীয় বজায় রাখতে ওই বাড়িটি বেঁছে নিয়েছে।
ইতিহাস বলছে, ১৭০০ শতাব্দীর শেষের দিকে জমিদার রাখাল রাজা কমলপুর নামক এলাকায় অর্ধশতাধিক একর জায়গাজুড়ে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার রাখাল রাজা ছিলেন অত্যাচারী জমিদার। তিনি তার জমিদারী আওতাভুক্ত এলাকার মুসলিম সুন্দরী রমণীদেরকে তার পাইকপেয়াদা দিয়ে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মেরে পেলতেন। আর এইসব অত্যাচারের ফলে অনেক মুসলিম পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। পরবর্তীতে জমিদারী এলাকার সকল মুসলমান একত্রিত হয়ে জমিদার রাখাল রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকেন। আর এই আন্দোলনের ফলে জমিদার রাখাল রাজা তার পরিবার নিয়ে জমিদারী ছেড়ে পালিয়ে যায় অন্যত্র।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, রাখাল রাজা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর বাড়িটি জমিদার বংশধরদের মালিকানাধীন আওতাধীন এখন আর নেই। তৎকালীন ওই অঞ্চল থেকে রাখাল রাজা জমিদারি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর। এলাকার কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন রাখাল রাজার সব সম্পত্তিগুলো দখলে নিয়ে বসবাস শুরু করে। জমিদারি রাখাল রাজার জমিদার বাড়ি, কয়েকটি পুকুর ও দিঘি হিন্দু পরিবারের গিরিশ চন্দ্র মজুমদার ও কালা মনা মজুমদার নামে দুই ব্যক্তি দখলে নিয়ে গেলেও বসবাস করতে পারেননি বেশিদিন তারা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তৎকালীন সময়ে ওই অঞ্চলের চইয়ান বাড়ীর বাসিন্দা (মুসলিম পরিবারের সন্তান) মজিদ পন্ডিত ব্যক্তির কাছে প্রায় ৩২ একর সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতের চলে যায় গিরিশ চন্দ্র মজুমদার ও কালা মনা মজুমদারসহ হিন্দু পরিবারের লোকজন। মুসলিম পরিবারের মজিদ পন্ডিত ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীনের পূর্বেই তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তার বংশধরের মধ্যে ৩ ছেলে ডা: জয়নাল আবেদীন ১৯৭৪ সালে মারা যায়। আবদুল বারেক ও আবদুল মুনাফের মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যায়ইনি তবে তারা যুদ্ধের পরে মৃত বরণ করেছেন বলে জানা যায়।
মজিদ পন্ডিতের বংশধরের মধ্যে ডা: ফারুক বাড়িটিতে বসবাস না করলেও তিনি পরিবার নিয়ে আমেরিকান প্রবাসে বসবাস করছেন। বর্তমানে বাড়িতে প্রবাসী ডা: ফারুকের আত্মীয় লোকজন থাকছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রবেশমুখে দু’টি সুন্দর কারুকার্য খচিত বৈঠকখানা, শিব মন্দিরের দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠছে লতাপাতা। বাড়ির পশ্চিমে দেখা মিলে দরজা-জানালা বিহীন একটি দোতলা ভবন। প্রাচীন এ স্থাপনা ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনের ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ময়লা আবর্জনা স্তূপ। সেখানে-সেখানে মল-মূত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেও দেখা দেখা যায়। প্রতিটি কক্ষে খসে পড়ছে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা। দেওয়ালজুড়ে বেয়ে উঠছে লতাপাতা। ভবনের দরজা-জানালা কিছুই নেই। সব কিছু খুলে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভবনের ইট-পাথরও। স্থাপনাটির নিচতলা পশ্চিম রুমে দেখা গেছে বড় কয়েকটি মাটির গর্ত, সেটির উপর টিন দিয়ে ঢাকনা দেয়া রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত একমাস পূর্বে রাতে কে-বা কারা মাটি গর্ত করে হয়তো জমিদারীর গুপ্ত কিছু নিয়ে গেছে দূর্বৃত্তরা।
ভবনের সামনে উঠুনে দেখা মিলে দুই ব্যক্তিকে তারা হলেন, মৃত ডা: জয়নাল আবেদীনের আত্মীয় এবং এ বাড়িতে বসবাসকারী ৬০ বয়সের এক বৃদ্ধ আবদুল বাতেন ও পাশের ঘরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেনের স্ত্রী তারা জানান, মৃত ডা: জয়নাল আবেদীনের ছেলে ডা: ফারুক সাহেব তার পরিবার নিয়ে আমেরিকা থাকেন মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। ডা: ফারুক সাহেবের অনুরোধে এ বাড়িতে তিনি থাকেন। পরিত্যক্ত প্রাচীন এ ভবনগুলো একনজর দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন লোকজন কাউকে কিছু বলতেও পারি না আমরা। সন্ধ্যার পর ভবনটির ভেতরে ঢুকে আড্ডা দেয়। ওরা ভবনের ভেতরে গিয়ে কী করে তাও ভয়ে দেখতে যাই না। আমেরিকান প্রবাসী ডা: ফারুক তার বাবা-মায়ের নামে একটি হাসপাতাল করার জন্য তিনি ২০০৬ সালে দেশে এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে এবং জমিদারদের রেখে যাওয়া যেসব ভবনগুলো রয়েছে সেগুলো নিজের অর্থায়নে সংস্করণ করার জন্য এলাকার লোকজন ও সরকারি ভাবে সহযোগিতা না পাওয়া কারনে কিছুই করতে পারিনি। ২০১২ সালে এ বাড়িতে ডাকাতেরা হামলা চালায় ওই সময় ডাকাতরা তাকে গুরুতর আহত করে।
স্থানীয় জনতা বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী বলেন,
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক ধরনের ফল খাওয়ার জন্য জমিদার বাড়িতে যাওয়া হতো, এখন আর কোন ফল গাছ দেখিনা। বাড়ির মালিক প্রবাসী ডা: ফারুক সাহেব একসময় উদ্যোগ নিয়েছেন জায়গাগুলোর মধ্যে তিনি হাসপাতাল ও পরিত্যক্ত জমিদার ভবনটি সংস্করণ করার জন্য। কিন্তু সরকারিভাবে কোন সহোযোগিতায় পাননি তিনি। এখানকার আশেপাশে তেমন কোথাও দর্শনীয় স্থান না থাকায় প্রাচীন এ বাড়িটি একনজর দেখতে এখনও বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের তদারকি না করায় জরাজীর্ণ ধ্বংসাবশেষ ভবনটি। এছাড়া জমিদার বাড়ি ও পুকুর দিঘি পাড়ে বহিরাগত মাদকসেবিদের আড্ডার কারণে এলাকার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। আড্ডার হাত থেকে বাড়িটি রক্ষা করার জন্য প্রশাসনের কাছে আমরা জোর দাবি জানাই।
