রবিবার, ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কারিগরি শিক্ষাই পারে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচাতে

কারিগরি শিক্ষাই পারে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচাতে
৪০ Views

            গাজী মিজানুর রহমান\ লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার (১১ই আগস্ট, ২০২৫) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, খোদ ব্রিটেনেই বিজ্ঞজনরা বলছেন, এ লেভেল (আমাদের এইচএসসি সমমান) পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ৫০ শতাংশের বেশির বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া উচিত নয়। তারা মনে করেন, উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে তারা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করে কাজে ঢুকে পড়লে যুবশ্রেণির মধ্যে বেকার সমস্যা দূরীভূত হবে। এই যদি হয় ব্রিটেনের অবস্থা, তাহলে আমাদের দেশে, যেখানে উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের বাজার সীমাবদ্ধ, সেখানে কারিগরি শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়া কতটা জরুরি, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

            দেশে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শহর-বন্দর-গঞ্জে অবিরত ঘরবাড়ি উঠছেই। সেই সঙ্গে সবার রুচি বদলাচ্ছে। ঝকঝকে নতুন বাড়ি চাই, বাড়িতে নানারকম আধুনিক সুবিধা থাকা চাই। এজন্য ভবন নির্মাণকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগরি কাজ জানা কর্মীর প্রচুর চাহিদা। তাদের সবার হাতে অঢেল কাজ। ওরা বড় কাজ করে পারে না, তাই ছোটখাটো মেরামত কাজ ফিরিয়ে দেয়। বাসায় কোনো কাজ করাতে চাইলে অনেক দিনের পরিচিত মিস্ত্রি আছে যাদের, তাদের জন্য চট করে লোক পাওয়া সহজ, যেহেতু পুরোনো কাস্টমার ধরে রাখার প্রশ্নে তারা কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু নতুনভাবে কাউকে ডাকলে পাওয়া মুশকিল। এ থেকে বোঝা যায় কারিগরি কাজ জানা লোকের চাহিদা কত বেশি। এ চিত্র দেশের সবখানে, সব জেলায়, সব উপজেলায়। ইলেক্ট্রিক কাজ, প্লাম্বিং কাজ, কাঠ মিস্ত্রির কাজ, গ্রিল মিস্ত্রির কাজ ইত্যাদি কাজের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

            কারিগরি কাজগুলো সব দেশে বেশ ভদ্রগোছের পেশা বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো কাজে শিক্ষানবিশ থেকে দক্ষ মিস্ত্রি গড়ে ওঠে নেহাত অনানুষ্ঠানিকভাবে। তারা অল্পশিক্ষিত এবং অল্পশিক্ষিতের অধীনে কাজ করে কাজ শেখে, তাই তাদের পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে গড়ে উঠতে পারে না। এ বাস্তবতা সামাজিক অবস্থানে তাদের উপরের দিকে টেনে নিতে পারছে না। ফলে অনেকেই এ পেশার কাজে আসতে অনীহা দেখায়। যদি শিক্ষিত হয়ে একটা লেভেলের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকে এবং মর্যাদার সঙ্গে আপস না করতে হয়, তাহলে শিক্ষিত যুবকরা আরও বেশি এদিকে আসবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশে বিভিন্ন দপ্তরের উদ্যোগে যেসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে যাতে একজন দক্ষ মিস্ত্রি গড়ে উঠতে পারে, তেমন সুবিধা থাকা দরকার।

এসএসসি পাশের পর যদি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটে বা এ ধরনের টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানে এইচএসসির সমান মর্যাদা দিয়ে কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে যুবসমাজের মধ্যে অনেকে এসব পেশার প্রতি আকৃষ্ট হতো। কারিগরি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান থাকা সত্তে¡ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি না পেয়ে কেউ বেকার জীবনের দিকে ধাবিত হতো না। এ লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হলে ডিপ্লোমার নিচের স্তরের যে সার্টিফিকেট কোর্স আছে, সেই শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী প্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে। সব পলিটেকনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব কোর্স ব্যাপকভাবে চালু করা দরকার। পাশ করার পর সার্টিফিকেটধারী টেকনিশিয়ানরা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ পায়, তাহলে তারা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে নিজেরাই ছোটখাটো উদ্যোক্তা হয়ে যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মালিক যখন নিজ হাতে কাজ করবে, তখন সে শ্রমিক নয়, উদ্যোক্তা; তার সম্মান আলাদা। এভাবে এ খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সম্মান আর পাঁচজনকে টেনে আনবে কারিগরি বিষয়ে পড়ার জন্য।

            এখন যেভাবে চলছে তাতে দেখা যায়, নিম্নস্তরের কারিগরি শিক্ষার সুযোগ খুব কম থাকায় আগ্রহী যুবকরা একজন ভালো মিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করে ২-৩ বছর পর একজন অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কর্মী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু যেহেতু তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি নেই, তাই সারাজীবন তারা নিজের পেশাকে বড় মাপের কাজ বলে ভাবে না। কিন্তু যদি শিক্ষা গ্রহণ করে পেশায় আসে, তখন তারা একেকজন আত্মবিশ্বাসী কর্মী হিসাবে পরিগণিত হবে।

উচ্চশিক্ষার তুলনায় কম সময়ে ও কম খরচে একটা কারিগরি শিক্ষার সনদ নিয়ে যদি মর্যাদার সঙ্গে ১৮-১৯ বছর বয়স থেকেই রোজগার করার সুযোগ আসে, তাহলে এ পেশায় আসতে কেউ দ্বিধা করবে না। পেশাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা, যা যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হতাশা দূর করতে পারে। উন্নত দেশগুলো যখন এসব কথা ভাবছে, তখন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ কেন তা ভাববে না? তাই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিচের স্তরের সার্টিফিকেট কোর্সের আওতাভুক্ত পড়ালেখা ও শিক্ষানবিশের মাধ্যমে কারিগরি পেশার জ্ঞান লাভের সুযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করা দরকার।

লেখক: সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও প্রাবন্ধিক

Share This

COMMENTS