শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভারতীয় উপমহাদেশে পত্রিকা ও ‘লাকসামবার্তা’

ভারতীয় উপমহাদেশে পত্রিকা ও ‘লাকসামবার্তা’

অধ্যক্ষ মোঃ ইয়াছিন মজুমদার

            শতাব্দী ধরে মানুষের কাছে সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ করার জন্য ছাপার মাধ্যম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সবচেয়ে প্রাচীন সংবাদপত্র হলো রোমের ‘অ্যাক্টা’ দিউরনা এবং প্রকাশিত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯ অব্দে। জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি অবহিত করার জন্য জুলিয়াস সিজার প্রধান শহরগুলোতে সংবাদ প্রেরণের ব্যবস্থা করতে চাইলেন। বিশাল সাদা বোর্ডের এই ‘অ্যাক্টা’ সরকারের স্ক্যান্ডালস, মিলিটারি ক্যাম্পেইন কিংবা বিচার ও মৃত্যুদন্ডের সংবাদ লিখে প্রদর্শনের জন্য রাখা হতো বাথের মতো জনবহুল শহরগুলোতে। সর্বপ্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় অষ্টম শতাব্দীতে চীনে। হাতের লেখা সংবাদ-সংবলিত কাগজ বিলি করা হতো বেইজিংয়ে। ১৪৪৭ সালে জোহান গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করার সাথে সাথেই সূচিত হয় সংবাদপত্রের আধুনিক যুগ। গুটেনবার্গের এই যন্ত্র, চিন্তার অবাধ আদান-প্রদান ও জ্ঞান বিস্তৃতিতে ভূমিকা রাখে। ফলে ইউরোপীয় রেনেসাঁর বিষয়বস্তু সংজ্ঞায়িত করা সহজ হয়। এই সময়ে, নিউজলেটারগুলো উঠতি বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রদান করত। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মানির শহরগুলোতে সার্কুলেশন হতো ম্যানুসক্রিপ্ট বা হাতের লেখা নিউজশিটস্। এই প্যামফেট বা সংবাদপুস্তিকা ছিল দারুণ স্পর্শকাতরতায় পরিপূর্ণ। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, জার্মানরা ট্রানসিলভ্যানিয়াতে সেপেড্রাকুলের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে, যা কাউন্ট ড্রাকুলা হিসেবেও পরিচিত ছিল। ১৫৫৬ সালে ভ্যানিস সরকার প্রকাশ করে ‘নোটিজি স্ক্রিটে’। এর জন্য পাঠকদের মূল্য প্রদান করতে হতো ছোট একটি সিকি বা ‘গেজেট’।

            সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রথম আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে, যেমন জার্মানি (জবষধঃরড়হ, ১৬০৫), ফ্রান্স (এধুবঃঃব, ১৬৩১), বেলজিয়াম (ঘরবঁবি ঞরলফরহমবহ, ১৬১৬) ও ইংল্যান্ডে (খড়হফড়হ এধুবঃঃব,১৬৬৫)। এসব সাময়িক পত্রিকায় সাধারণত ইউরোপের সংবাদ ছাপা হতো; মাঝে মাঝে আমেরিকা ও এশিয়ার খবরও থাকত। অভ্যন্তরীণ সংবাদ কমই প্রকাশ পেত। বরং ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশ করত ফ্রান্স মিলিটারির সাংঘাতিক ভুলগুলো আর ফ্রান্স প্রকাশ করত ব্রিটিশ-রাজের তাজা স্ক্যান্ডাল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে সংবাদপত্রগুলো স্থানীয় সংবাদ প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেন্সরশিপ জারি ছিল ও বিরুদ্ধমতের জনগণকে প্ররোচিত করতে পারে এমন সংবাদ প্রকাশের অনুমতি প্রায় মিলতই না। ১৭৬৬ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের অনিচ্ছা সত্তে¡ও গৃহযুদ্ধ শেষে চার্লস ফার্স্টের শিরদেকে সংবাদ শিরোনাম করে পত্রিকাগুলো। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সপক্ষে সুইডেন সর্বপ্রথম আইন প্রণয়ন করে।

            ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল এডভার্টাইজার নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিকী প্রকাশ করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস ও তার পতœী ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনা মূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে শিক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। ১৮১৮ সালের এপ্রিলে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিকদর্শন প্রকাশ করা হয়। ১৮১৮ সালের ২৩শে মে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কুমুদিনী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফারসিতে মিরাতুল আকবর প্রকাশ করেন। ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলা যন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট পরবর্তীতে তা ইংলিশ ম্যান নামে নামকরণ হয় এবং নীলকরদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে।

            এরপর ১৮৪৪ সালে টেলিগ্রাফের আবিষ্কার সংবাদপত্রের জগতে নতুন দ্বার উন্মোচন করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রাসঙ্গিক তথ্য আদান-প্রদান সম্ভবপর হলো। সমাজের প্রায় সব স্তরে ছড়িয়ে পড়ল পত্রিকা।

            ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়ার। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভাতৃদ্বয় যশোহরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুয়া মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন।

            জাপানের প্রথম সংবাদপত্র ‘ইয়োকোহামা মাইনিচি শিমবান’ আত্মপ্রকাশ করে ১৮৭০ সালে, যদিও স্থানান্তরযোগ্য টাইপ থেকে ছাপার ব্যবহার শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে।

            ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্রনাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। অমৃতবাজার পত্রিকার সহ কিছু স্থানীয় পত্রিকা নীল চাষীদের পাবলম্বন করে। এতে বুঝা যায় নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশের জন্য সংবাদ পত্র ও সাংবাদিকরা যুগে যুগে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে যেমনি পড়েছে- অপরদিকে স্বার্থের জন্য কিছু সংবাদপত্র ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে শাসকদের লেজুড়বৃত্তিও করেছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তথ্য আদান-প্রদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় সংবাদপত্র। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ এই সময়কালকে প্রিন্ট মিডিয়ার ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এ সময় উইলিয়াম হার্স্ট, জোসেফ পুলিৎজার ও লর্ড নর্থকিফ বিশাল প্রকাশনা-সা¤্রাজ্য গড়ে তোলেন। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে তাঁদের প্রভাব ছিল অসামান্য।

            ১৯০৩ সালের সৈয়দ এমদাদ আলীর মাসিক সাহিত্য পত্র নব-নূর প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা সমাচার সভারাজেন্দ্র বের হয়। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন এর মাসিক সওগাত। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের মাসিক সাধনা। ১৯২০ সালে মোজাম্মেল হকের মোসলেম ভারত। কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ, নাঙ্গল, ধুমকেতু।              অত:পর, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার প্রথম দৈনিক পয়গাম। ১৯৪৯ থেকে দৈনিক ইত্তেফাক। ১৯৫১ থেকে দৈনিক সংবাদ ছাপা হতে থাকে। উপরে বর্ণিত পত্রিকা ছাড়া সে সময় আরও কিছু পত্রিকাও ছাপা হয়।

            উল্লিখিত তালিকা থেকে আমরা পত্রিকা প্রকাশের ইতিহাসের যে বিবরণ দেখি, তন্মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তৎসময়ের শিক্ষিত গুণীজনরাই সমাজ পরিবর্তন ও সমাজ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পত্রিকা প্রকাশকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষিত, সমাজসেবক ব্যক্তিরা পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। এমনি একটি পত্রিকা মফঃস্বল থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক লাকসামবার্তা। শিক্ষা জীবন শেষে যুবক বয়সে কেয়ারী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়া পরিবারের মরহুম হাজী আইউব আলী ভূঁইয়ার ছেলে জনাব শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু করেন। তার কর্ম প্রচেষ্টায় দেশে মফস্বলের সর্বাধিক প্রচারিত ও সরকারি মিডিয়া ভুক্তির মত অবস্থানে পত্রিকাটি স্থান পায়। যদিও বর্তমানে সাংবাদিকতাকে অনেকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন, কিন্তু শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া পত্রিকাটিকে জনসেবা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। তিনি ও তার সন্তানেরা স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় ভালো অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া বছরে দু’তিনবারও দেশ মাতৃকার টানে, তার পত্রিকার টানে সুদূর আমেরিকা থেকেও বাংলাদেশে চলে আসেন। নিজ উপার্জিত অর্থ দ্বারা তিনি পত্রিকাটি সমৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে থাকেন। তারই পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে, লেখক হিসেবে বা তার পত্রিকা অফিসে এক সময় যারা কাজ করেছেন- তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ নিজেরাই পত্রিকা প্রকাশ করছেন। আবার কেউ জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক হওয়ারও সুযোগ লাভ করেছেন। আসলে তিনি একজন সাহিত্য প্রেমী। তাই লেখকদের যথাযথ সম্মানও করে থাকেন। আমরা দু’চার কলম যারা লিখি- তারা তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ, তার ব্যবহারে আপ্লুত। একেবারেই নিরহঙ্কারী মানুষটির জীবনেরই একটা অংশ সাহিত্য ও তার পত্রিকা। এ পত্রিকার মাধ্যমেই চলছে তার সামাজিক কাজ বা সমাজ পরিবর্তনের কাজ। এই কাজে অংশীদার আছেন সহযোগী সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ সাহেবসহ অন্যান্যরাও। তোফায়েল সাহেব পত্রিকাটির এ ধারা অব্যাহত রাখতে, বিশেষ করে করোনার কারণে সংবাদপত্র যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- তার ধকল কাটিয়ে উঠতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে লাকসামবার্তা পত্রিকার পাঠক, গঠিত হয়েছে লাকসামবার্তা পাঠক ফোরাম। পত্রিকাটি যেমনি আমাদের কাছের খবরগুলো প্রকাশ করে থাকেন, সে সাথে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকগুলোও তুলে ধরছেন। কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে, আবার কারো রক্তচক্ষুকে ভয় না করে, সমাজ পরিবর্তনে নিরলসভাবেই কাজ করে যাচ্ছে সাপ্তাহিক লাকসামবার্তা।

            মূলত: রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের বর্তমান যুগেও প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয় বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। কাগজের পাতায় ছাপার অক্ষরে চিরস্থায়ী লেখাগুলোই হয়ে থাকবে কালের সমুজ্জ্বল সাক্ষী। এই কাজ আমলে সালেহ তথা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্তই। আল্লাহ পাক তাদের এ সৎ কাজের উসিলায় দুনিয়ায় কল্যাণ মন্জুর করুক এবং আখেরাতে মুক্তি দান করুক। সকলের ভালোবাসা নিয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক সাপ্তাহিক লাকসাম বার্তা।

            (লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা)। মোবাইল নং ০১৯৭১৮৬৪৫৮৯

Share This