শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পানি শূন্য ডাকাতিয়া

পানি শূন্য ডাকাতিয়া

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ এককালের খর¯্রােতা ডাকাতিয়া নদী এখন পানিশূন্য। নদীর বুকে বালুচর। কুমিল্লা জেলার লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদী বর্তমানে এলাকাবাসীর কোনো উপকারে আসছেনা। ৩৫-৪০ বছর আগেও নদীটি ছিল অত্রাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। সে সময় ডাকাতিয়া ছিল পূর্ণ যৌবনা। ছিল ঢেউ। ঢেউয়ের তালে তালে চলতো অসংখ্য পালতোলা নৌকা, লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলার। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা ফসল আবাদের সময় এ নদী থেকে পেত পর্যাপ্ত পানি। ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। ডাকাতিয়া নদী ছিল এ অঞ্চলের বহু মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। সময় গড়িয়ে ভরা যৌবনা ডাকাতিয়া এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। পলি জমে নাব্যতাসংকটের কারণে বছরের অধিকাংশ সময় নদীটি থাকে ধু ধু বালুচরে। এতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষকেরা। নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করতে না পারায় ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে চাষিদের। ডাকাতিয়া নদী এক সময় দক্ষিণ কুমিল্লাসহ চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষের কাছে আশীর্বাদের হলেও বর্তমানে নদীটি অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়,  ডাকাতিয়ার বুকে এখন কোথাও ফসলের ক্ষেত, আবার কোথাও ফেটে চৌচির নদীর তলদেশ। আবার কোথাও কোথাও ডাকাতি করে মাটিও কেটে নেয়া হচ্ছে ডাকাতিয়ার বুক থেকে। নদীর দু’পাড়ে অবাধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর নির্মাণ করেছে মানুষ। বিভিন্ন স্থানে কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বিষাক্ত করে তুলেছে নদীটিকে। এছাড়া, যুগ যুগ ধরে খনন না করায় পলি জমে ভরাট হয়ে নদীটি নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে নদীটি দখল-দূষণ এবং ভরাটের ফলে নদীর তলদেশে মাইলের পর মাইল বালুচর জেগে নাব্য হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে এখন আর নদীটিতে পানি থাকে না। সেচের সময় বা বোরো মৌসুমে ডাকাতিয়া হয়ে উঠে ধু-ধু বালুচর।

            জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ডাকাতিয়া নদী। এরপর কুমিল্লা জেলার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ২০৭ কিলোমিটার। প্রস্থ ৬৭ মিটার (প্রায় ২২০ ফুট)। নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি রক্ষণাবেণের দায়িত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডর। এদিকে নদীটির নামকরণ নিয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে, সম্ভবত এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করত এবং নদীতে এরা ডাকাতি করত। ডাকাতের উৎপাতের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০৭ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির কোথাও বর্তমানে ২২০ ফুট প্রস্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। দখল হতে হতে নদীটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে বললেই হয়। ২২০ ফুটের নদীটি কোথাও ৩০ ফুট আবার কোথাও ৪০ ফুটে পৌঁছেছে।

            লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বাপ্পি বলেন, প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির ব্যবসায়ীরা তাদের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলছেন। এ ছাড়াও স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের দোকানের উচ্ছিষ্টসহ বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নদীতে ফেলে নদীকে দূষিত করছেন।

            সিনিয়র সাংবাদিক এম,এস দোহা বলেন, ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে জন্ম হয়ে বেড়ে উঠার কত না স্মৃতি মনে ভাসাছে। একসময় এই অঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নৌ-পথ। ওই সময় বিভিন্ন পণ্যবাহী বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ এই নদীপথ দিয়ে চলাচল করত। নৌ যোগাযোগের সুবিধার কারণে এই নদীপথে শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ, লক্ষীপুর, চাঁদপুরসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলার লোকজন লাকসামে এসে বাণিজ্য করত। এছাড়া আগে খর¯্রােত এই নদীতে ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। কয়েক হাজার জেলে এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে প্রভাবশালীরা নদীটি দখল করে নিচ্ছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দ্রæত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। না হয় একসময় ডাকাতিয়া নদীর অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

            পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ইতোমধ্যে নতুন ডাকাতিয়ার ১২ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। পুরনো ডাকাতিয়ার লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ অংশে খনন করার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরেই কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও বিআইডবিø­উটিএ’র সহযোগিতায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে শীঘ্রই।

Share This