শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষের কারণ অজ্ঞতা

মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষের কারণ অজ্ঞতা

অধ্যক্ষ ইয়াছিন মজুমদার: আমি এ পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি মাদরাসা বিদ্বেষীরা দুই ধরনের, প্রথম ধরনের ব্যক্তিরা উচ্চশিক্ষিত, অনেকে ধর্মবিরূপ। তাদেরকে বলতে শোনা যায় মাদরাসায় পড়ে মোল্লা হলে দেশের কোন লাভ নেই, তারা দেশে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে। যারা এ কথা বলে তাদের অধিকাংশেরই আলীয়া মাদরাসার বর্তমান সিলেবাস সম্পর্কে আদৌ ধারণা নেই। তারা জানে না মাদরাসায় হুবহু স্কুল-কলেজের পাঠ্যভুক্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, আইসিটিসহ সকল বিষয় পাঠ্যভুক্ত রয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগ, সাধারণ বিভাগ, ব্যবসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা বিভাগ রয়েছে। সে সাথে মাদরাসার আরবি বিষয়গুলো রয়েছে। সনদের মান সমমান দেয়া হয়েছে। মাদরাসার ছাত্ররা সকল ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতার পরিচয়ও দিচ্ছে। আমি একান্ত আমার নিজের সন্তানকে দিয়ে উদাহরণ দিচ্ছি- আমার দ্বিতীয় পুত্র প্রথম শ্রেণী থেকেই মাদরাসায় লেখাপড়া করেছে। মাদরাসার দাখিল (এসএসসি সমমান) স্থানীয় মাদরাসা থেকে উত্তীর্ণ হয়। আলিম (এইচএসসি সমমান) তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী শাখা থেকে (চলতি বর্ষ, ২০২৩ পরীক্ষার্থী) উত্তীর্ণ হয়। তাকে বললাম তুমি মাদরাসাতে থাকো। সে বলল আমি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেব যদি উত্তীর্ণ হই তবে সেখানে ভর্তি হব, আর উত্তীর্ণ না হলে আমি মাদরাসাতেই থাকবো। সে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তার সহপাঠী প্রথম শ্রেণী থেকে একই সাথে একই মাদরাসাতেই তারা লেখাপড়া করেছে। সে ডাক্তারি পড়বে না, সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, এম আই এস টি, আই ইউ বিসহ সকল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভার্সিটিতে সে মেধা তালিকায় প্রথম দিকে ছিল। শেষে বুয়েটে ইলেকট্রিক এন্ড ইলেকট্রনিক্স (ত্রিপলী) বিষয়ে ভর্তি হয়। তাদের এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। তামিরুল মিল্লাত মাদরাসা থেকে আমার ছেলের সহপাঠীদের মধ্যে এ বছর ২০ জন ছাত্র শুধু মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে। গত বছর ১৭ জন, এর আগের বছর ২৩ জন ছাত্র মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে বহু ছাত্র সুযোগ পেয়েছে। এভাবে দেশে বহু মাদরাসার তাদের মেধার পরিচয় দিচ্ছে। তারপরও এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোক মাদরাসায় পড়ে মোল্লা হওয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে না বলে মত প্রকাশ করে থাকেন। এটা তাদের অজ্ঞতা বই আর কিছু নয়। আমার বড় ছেলেও মাদরাসা থেকে দাখিল (এসএসসি সমমান) পাশ করে ঢাকা উত্তরার একটি নাম করা কলেজে এইচএসসি ভর্তি হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সিএসই বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তার জন্য আমার যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, হোস্টেলে খাওয়া দাওয়া ও মান সম্মত ছিল না। দ্বিতীয় ছেলের জন্য তার অর্ধেকও ব্যয় হয়নি। হোস্টেলের খাওয়াও মোটামুটি ভালো ছিল। আমার বড় ছেলেকে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা টঙ্গী শাখায় পড়ালে আমার মনে হয় কলেজ থেকে ব্যয়ও কম হতো এবং সে পড়ালেখায় আরো ভালো করতো। সেখানে ছাত্র রাজনীতির কোনা চাপ নেই। আবার কেউ কেউ বলেন আলিয়া, কওমি, নূরানী কত রকমের মাদরাসা এত বিভাজন কেন? অথচ ক্যাডেট স্কুল, কিন্ডার গার্টেন, করপোরেশন পরিচালিত স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কত ধরণের স্কুল রয়েছে যেখানে তারা বিভাজন দেখেন না!! অপরদিকে আমাদের কওমি অঙ্গনের কিছু আলেম আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া নেই, কলেজ হয়ে গেছে, ভালো আলেম হতে পারবে না ইত্যাদি প্রচারণা চালায়। এটাও তাদের অজ্ঞতা। আলিয়া মাদরাসায় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কোরআন, আকাইদ, ফিকহ, মিজান (সরফ) আরবি দ্বিতীয় পত্র (নাহু) আরবি প্রথম পত্র (আদব) পাঠ্য রয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণীতে এগুলোর সাথে হাদিস (মেশকাত) ফিকহ (কুদুরী) উচুলে শাশি, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ্য রয়েছে। আরবি সাহিত্য (আদব) ও নাহু কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় শতভাগ আরবিতেই উত্তর দিতে হয়। আলিম শ্রেণীতে এগুলোর সাথে বালাগাত, মানতেক, নুরুল আনোয়ার, শরহে বেকায়া, হেদায়েতুন নাহু, ফরায়েজ (সিরাজী) পাঠ্য রয়েছে। ফাজিল শ্রেণীতে হেদায়া, তাফসিরে জালালাইন, আকাইদ, উসুলে তাফসির, উসুলে হাদিস পাঠ্য রয়েছে। কামিল শ্রেণীতে বিভাগ ওয়ারি বিষয়গুলো সাথে প্রতি বিভাগেই তাফসীর, হাদিস ইত্যাদি রয়েছে, যেমন হাদিস বিভাগে সিহাসিত্তার সকল গ্রন্থ পূর্ণ সিলেবাস রয়েছে, সে সাথে তাফসীরে বাইদাবী, তাফসীরে কাশাফ সিলেবাসে রয়েছে। ফিকহ বিভাগে ফিকহের কিতাবগুলোর সাথে সাথে তাফসীর হাদিস ইত্যাদি ও সিলেবাসে রয়েছে। কওমি মাদরাসায় আর বেশি কোন কোন কিতাব পাঠ্য আমার জানা নেই। আর আলেম হওয়ার জন্য আর কি প্রয়োজন। তাহলে আলিয়ায় পড়ে ভালো আলেম হতে পারবেনা, কলেজ হয়ে গেছে এ জাতীয় প্রচারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে হ্যাঁ আলিয়া মাদরাসায় কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত সাধারণ বিষয়ের চাপ একটু বেশি, যা না হলে আরবি বিষয়গুলোর প্রতি আরো মনোযোগী হতে পারতো। দ্বিতীয়তঃ আলীয়ার মেধাবী যারা, যেমন এমন ছাত্র অনেক রয়েছে যারা দাখিল আলিমে পড়াকালীন আরবি কথোপকোথন ও আরবি ভাষায় অনুবাদে পারদর্শিতা অর্জন করে কিন্তু সেই মেধাবীরা কলেজ ভার্সিটির দিকে চলে যায় ফলে  অপেক্ষাকৃত কম মেধাবিরা মাদরাসায় থেকে যায়। ভালো মেধাবী হলে ভালো আলেম হওয়া সুবিধা। আবার হোস্টেল ব্যবস্থা না থাকায় সার্বক্ষণিক তদারকি হয়না। সরকারি বেতন ভাতা পাওয়ায় ছাত্র গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধির প্রচেষ্টা কম থাকে। নিচের দিকে নুরানী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা ও হেফজের ব্যবস্থা না থাকায় তাজবিদে দুর্বলতা থাকে। অবশ্য অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রচেষ্টায় এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। এ সকল সমস্যা উত্তরণে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা নিলে আলীয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাই হবে অন্যতম শিক্ষা ব্যবস্থা।

লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা। মোবাইলঃ ০১৯৭১-৮৬৪৫৮৯

Share This

COMMENTS