শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ইয়াছিন মজুমদারঃ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার অনেক। অমুসলিম নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার, নির্বিঘেœ চলাফেরা করার অধিকার, লেনদেন করার অধিকার, নাগরিক সুবিধা ও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, এটাই ইসলামের বিধান। নবী (সাঃ) যখন মদিনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন মদিনায় মুসলিমের সংখ্যা ছিল অনেক কম। তুলনামূলক ইহুদি ও অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল বেশি। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের কোন অধিকার ক্ষুন্ন হয়নি, যতক্ষণ না তাদের কোন গোত্র সরাসরি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র বা রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজে লিপ্ত না হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল আমল থেকে বহু শতাব্দী মুসলিম শাসনে ছিল। অথচ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দু। তখন ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় তাদের কোন সমস্যা হয়েছে এমন শোনা যায়নি। ইসলামী আইন অমুসলিমদের কোন ধর্মীয় আইনের বিপক্ষে কিছু করেনা। বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়া আইন নেই। তারপরও যতটুকু ইসলামী বিধান আছে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি- যেমন ধরুন একজন মুসলমান মারা গেলেন তার দেড় বিঘা জমি, এক ছেলে এক মেয়ে ছাড়া আর কোন ওয়ারিশ নেই। এক্ষেত্রে ছেলে এক বিঘা, মেয়ে আধা বিঘা জমি পাবে। অপরদিকে একজন হিন্দু মারা গেলেন। তারও এক ছেলে এক মেয়ে। এ ক্ষেত্রে ছেলে সম্পূর্ণ সম্পদ পাবে, মেয়ে সম্পদ পাবে না। দেখুন, সম্পদ হলো বেশি মূল্যবান। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে উভয় ধর্মের ধর্মীয় বিধান রক্ষিত হয়েছে। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও সকল আইনের ক্ষেত্রে যার যার ধর্মীয় আইন থাকলে তা সুরক্ষিত থাকবে। নবী (সঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যা করবে সে জান্নাতে যাবে না (মুসনাদে আহমদ ২০৬৪৮, বুখারী ৩১৬৬)। অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি ন্যায় বিচারের উদাহরণ ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রাঃ), তিনি তার ঢাল হারালেন, এক ইহুদির কাছে ঢালটি পাওয়া গেল। ইহুদি তা নিজের দাবি করল। তখন আলী (রাঃ) কাজীর নিকট (আদালতে) বিচার প্রার্থী হলেন। বিচারক আলী (রাঃ) কে সাক্ষী উপস্থিত করতে বললেন। তিনি তার ছেলে হাসান (রাঃ) ও তার গোলাম এ দু’জনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করে বললেন এরা দেখেছে এই ঢালটি আমার। বিচারক বললেন পিতার পক্ষে পুত্রের এবং মনিবের পক্ষে গোলামের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে সাক্ষীর অভাবে ঢালটি ইহুদিকে দিয়ে দেয়ার আদেশ দিলেন। মুসলমান মাত্রই কুরআন সুন্নাহ তথা ইসলামী আইন মানতে বাধ্য। সেজন্য ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র ইসলামী আইন না হলে ইসলাম পরিপূর্ণ পালন অসম্ভব। ইসলামী আইন অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামী আইনের কথা বললেই এটাকে সাম্প্রদায়িকতা অবহিত করে একশ্রেণীর লোক প্রচার করতে থাকে। বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন থেকেও এর বিরুদ্ধে বিবৃতি আসে। যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ইচ্ছার বিপরীত। অপরদিকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরকে অনেক সময় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে দেখা যায়। ফলে অন্য রাজনৈতিক দলের লোকেরা তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। কোন কোন হিন্দুর এদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুট করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া, অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। বিশ্বজিৎ হত্যায় কোন আন্দোলন করতে দেখা না যাওয়া তাদেরকে একপেশে মনে করা স্বাভাবিক। কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরা মন্দির ভেঙে অন্যের উপর দোষ চাপানোর খবরও পাওয়া যায়। ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। দীর্ঘ শাসনকালে যারা তাদের দ্বারা মামলা হামলা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের কেউ কেউ অতি ক্ষোভের কারণে, সে সাথে একশ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী টোকাই ও লুটেরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কিছু কিছু বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া ও লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে। সচেতন নাগরিক হিসেবে এই ধরনের ঘটনার নিন্দা করছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা দলীয় লেজুড় বৃত্তির সাথে জড়িত ছিল, মিটিং-মিছিলে দেখা গেছে, তাদের কারো কারো বাড়িঘরেও এরূপ ঘটনা ঘটেছে। যা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক কারণে হয়নি বরং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও সুযোগ সন্ধানী লুটেরাদের কাজ। মাদ্রাসার ছাত্ররাও হিন্দুদের বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছে। ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ হিন্দুদেরকে আশ্বস্ত করছে, সাহস জোগাচ্ছে। কিছু হিন্দু এটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেষ্টা করছে। তাই কেউ কেউ এটাকে এ সংকট মুহূর্তে সংকটকে বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টা মনে করছে যা হিন্দুদের উপর ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। এদেশের নাগরিক হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশের প্রতি আন্তরিক হয়ে দল নিরপেক্ষভাবে কাজ করা দরকার। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের, কোন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে অন্য দলের বিরাগভাজন হওয়া ঠিক হবে না। সে সাথে কোন ধরনের হামলার আশঙ্কা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে তা রোধ করা সম্ভব এবং এটি এখন রোধ করা সময়ের দাবীও বটে!
লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।

Share This

COMMENTS