শনিবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিশুশ্রমের কারণ ও করণীয়

১৩ Views

            আসআদ শাহীন\ শিশুশ্রম হলো এমন এক বাস্তবতা, যা একটি শিশুকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করে। জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে যে কোনো শিশুকে এমন কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ, যা তার শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অথচ বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

            বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশুশ্রমের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। বিশেষত বাংলাদেশ যেখানে দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও আর্থিক অসক্ষমতা শিশুশ্রমকে এক জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত করেছে। পোশাক কারখানা, ইটভাটা, চায়ের দোকান কিংবা গৃহস্থালির কাজে শিশুদের নিষ্ঠুর শোষণের শিকার হতে হয়। তারা দিনের পর দিন এই কঠিন শ্রমে নিজেদের স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়, আর শৈশবের হাসি পরিণত হয় নীরব কান্নায়।

            শিশুশ্রমের কারণঃ শিশুশ্রমের পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। তবে এর মূলে রয়েছে দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলোতে বেঁচে থাকার লড়াইই প্রধান। একজন শিশুকে স্কুলে পাঠানোর খরচ বহন করার সামর্থ্য যখন থাকে না, তখন তারা বাধ্য হয় সেই শিশুকে কাজে লাগাতে। অশিক্ষা আর সামাজিক সচেতনতার অভাবও শিশুশ্রমকে বাড়িয়ে তোলে। দরিদ্র পরিবারগুলোতে অনেক সময় শিশুশিক্ষার গুরুত্ব বোঝা হয় না। তারা মনে করে, শিশুরা ছোট বয়স থেকেই উপার্জনে যুক্ত হলে পরিবারে বাড়তি আয়ের সংস্থান হবে।

            তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতির সঠিক প্রয়োগের অভাব শিশুশ্রমকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। যদিও বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ, তবু অনেক জায়গায় এই আইন কার্যত অকার্যকর। শিশুশ্রমিকদের ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা তাদের সস্তা শ্রমের সুযোগ নিয়ে অনায়াসে এই প্রথা চালিয়ে যাচ্ছে।

            শিশুশ্রমের প্রভাবঃ একটি নিঃশব্দ বিপর্যয় শিশুশ্রম একটি শিশুর জীবনের মূল স্রোতকে থামিয়ে দেয়। শৈশব, যা হওয়ার কথা ছিল সৃজনশীলতার, শিক্ষার এবং আনন্দের মঞ্চ, তা পরিণত হয় দুঃখ আর ক্লান্তির কারাগারে। শিশুশ্রম শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয়। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অপুষ্টি এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাদের শরীরে রোগের বাসা বাঁধে। ইটভাটার গরম তাপ, কারখানার ধুলো, রাস্তার নির্মম পরিবেশ কিংবা গৃহস্থালির কাজে বাড়িওয়ালার অমানবিক নির্যাতনে শিশুরা নিজেদের জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে। শিশুশ্রমের কারণে শিক্ষা তাদের জীবনের পরিধি থেকে মুছে যায়। যারা শিশু বয়সে কাজ করতে বাধ্য হয়, তারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা ভবিষ্যতে উন্নত কোনো কাজের উপযুক্ত হয় না। তাদের জীবন চিরকাল নিম্ন আয়ের এক চক্রে আবদ্ধ থাকে।

            শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়; শিশুশ্রম মানসিকভাবেও শিশুদের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। কঠিন পরিশ্রম, অপমান এবং কখনো কখনো নির্যাতনের ফলে তারা এক ধরনের হতাশা আর ভয়ের শিকার হয়। এই শিশুরা নিজেদের আত্মমর্যাদাকে হারিয়ে ফেলে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকেও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে।

            শিশুশ্রম রোধে করণীয়ঃ শিশুশ্রম দূর করা কোনো সহজ কাজ নয়। এটি একদিনে বা কোনো একক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তবে একটি সুসংবদ্ধ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা শিশুশ্রমের এই ব্যাধিকে নির্মূল করতে পারে।

            প্রথমত, দারিদ্র্য দূরীকরণই শিশুশ্রম বন্ধের মূল চাবিকাঠি। দরিদ্র পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়ানো, ন্যায্য মজুরি প্রদান এবং সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করা যেতে পারে।

            দ্বিতীয়ত, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। শিশুদের জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে উৎসাহিত করতে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, খাবার ও আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। ‘মিড ডে মিল’ বা ‘শিক্ষা উপবৃত্তি’ কার্যক্রম এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

            তৃতীয়ত, আইনের সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার আইন কার্যকর করা ছাড়া এটি বন্ধ করা অসম্ভব। অতএব, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। শিশুশ্রম বিরোধী আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে এবং যারা এই প্রথাকে চালু রাখছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা ছাড়া সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। শিশুদের অধিকার এবং তাদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

Share This

COMMENTS