শুক্রবার, ৯ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা
Views

            আবু সায়েম\ ২০২৫ সালের বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রেস ফর দ্য প্ল্যানেট: জার্নালিজম ইন দ্য ফেইস অব দ্য এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিস’ মূলত পরিবেশ রক্ষায় সাংবাদিকতার অপরিহার্য ভূমিকাকে তুলে ধরে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, পানি দূষণ, শিল্পবর্জ্যসহ পরিবেশগত নানা সংকট যখন মানব সভ্যতার অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে, তখন সাংবাদিকতাকে কেবল তথ্য প্রচারের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং সচেতনতা সৃষ্টির অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই প্রতিপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সাংবাদিকদের দায়িত্ব শুধু রিপোর্টিংয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি নৈতিক দায়িত্বও।

            বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, পানির সংকট ও বায়ুদূষণÑ এই সব পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ দেশের কোটি মানুষের জীবিকা ও জীবনধারাকে প্রভাবিত করছে। অথচ এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যৃ নিয়ে গণমাধ্যমে বিশ্লেষণাত্মক ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এখনও সীমিত। প্রতিপাদ্যটি এই বাস্তবতায় সাংবাদিকতাকে পরিবেশ বিষয়ে অধিক মনোযোগী ও দায়বদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশে অনেক সময় অবৈধ ইটভাটা, বন উজাড়, নদী দখল, রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা, শিল্প দূষণ ইত্যাদি পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকান্ডের পেছনে প্রভাবশালী চক্র বা দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা থাকে। এসব ঘটনা অনুসন্ধানে সাহসী সাংবাদিকতার প্রয়োজন হয়।

            পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটি মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, কংগ্রেস কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না যা বাক্-স্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধা দেয়। এতে সাংবাদিকরা রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের নানা বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান ও সমালোচনা করতে পারেন, সরকারের পক্ষপাতমূলক হস্তক্ষেপ ছাড়াই। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ইইউ মিডিয়া ফ্রিডম আইনের মতো আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা হচ্ছে। উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পাবলিক ব্রডকাস্টিং সিস্টেম এবং সাংবাদিক ইউনিয়ন ও অ্যাডভোকেসি গ্রæপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন: বিবিসি ট্রাস্ট (যুক্তরাজ্যে) বা পিবিএস ও এনপিআর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত হলেও কার্যত স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করে। পাশাপাশি রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ নানা সিভিল সোসাইটি সংগঠন সরকারের সিদ্ধান্ত বা নীতিমালার সংবাদমাধ্যম-বিরোধী দিকগুলো নিয়ে সোচ্চার থাকে। ফলে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা শুধু আইনি নয়- সমাজের চর্চার মধ্যেও দৃঢ়ভাবে প্রোথিত।

            উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অনেক সময় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাধার মুখোমুখি হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার অতিসক্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা রাখে। এসব দেশে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি, মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার বা নিখোঁজ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে, যা সাংবাদিকতা চর্চাকে ভীতিকর ও সীমিত করে তোলে। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জনে ব্যর্থ অনেক গণমাধ্যম মালিকানাভিত্তিক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফলে সাংবাদিকরা অনেক সময় সম্পাদকীয় স্বাধীনতা হারান। পাশাপাশি অনেক উন্নয়নশীল দেশে মিডিয়া হাউজগুলোর বিজ্ঞাপন নির্ভরতা সরকারের কাছে একধরনের চাপ তৈরি করে, যার ফলে সরকারবিরোধী বা সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশে অনীহা দেখা যায়। আবার গণমানসিকতা ও রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রভাবে অনেক সময় সংবাদমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে, যার ফলে জনগণের আস্থা হারায় এবং সত্যিকারের মুক্ত সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়।

            সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে একদিকে যেমন সম্প্রসারিত করেছে, অন্যদিকে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। ফেসবুক, টুইটার (বর্তমান এক্স), ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল­্যাটফর্ম সাংবাদিকদের জন্য তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার, ভিন্নমত প্রকাশের এবং বিকল্প সংবাদ পরিবেশনের একটি স্বাধীন ও দ্রæতগতির মাধ্যম হয়ে উঠেছে। মূলধারার গণমাধ্যম যখন কোনো কারণে নিরব থাকে বা বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক সময় সত্য ঘটনাকে সামনে আনতে ভূমিকা রাখে, যা গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। তবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে মিথ্যা তথ্য, গুজব এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় সাংবাদিকরা সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি, চরিত্রহনন, এমনকি মৃত্যুর হুমকির শিকার হন। সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোও এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে নাগরিক সাংবাদিকতা ও স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ এক জোড়া ধারালো তরবারির মতো, যা একদিকে প্রেস ফ্রিডমের প্রসার ঘটায়, আবার অন্যদিকে তা সংকুচিত করার সুযোগও তৈরি করে।

            গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয় যখন গণমাধ্যম দায়িত্বশীলভাবে নির্ভরযোগ্য, তথ্যভিত্তিক এবং যাচাইকৃত সংবাদ পরিবেশন করে। এই পর্যায়ে ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাই একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত। সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্যের সত্যতা যাচাই সাংবাদিকতার নৈতিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বাধীন সাংবাদিকরা যখন যাচাইকৃত তথ্য নিয়ে কাজ করেন, তখন তা রাষ্ট্র, সমাজ এবং জনসাধারণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। অন্যদিকে, ফ্যাক্ট চেকিং প্রক্রিয়াকে যদি সীমিত করা হয় বা নিরপেক্ষভাবে চালাতে না দেয়া হয় তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়। তাই ফ্যাক্ট চেকিং শুধু সংবাদ শুদ্ধির মাধ্যম নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কার্যকর রাখে এবং অপপ্রচার, গুজব ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।

Share This

COMMENTS