রবিবার, ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নাঙ্গলকোটে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের ৩ বছরের মধ্যে ফাটল

নাঙ্গলকোটে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি সরকারি প্রাথমিক  বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের ৩ বছরের মধ্যে ফাটল
১২১ Views

           

আবুল কাশেম গাফুরী\ নাঙ্গলকোটে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শুরুতেই বেহাল দশা বিরাজ করছে। নির্মাণের ৩ বছরের মাথায় মূল ভবনের পিলারে ফাটল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কক্ষের ভিতরে ফাটল, ফ্লোরের ইট, বালু, সিমেন্ট উঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি, ছাদের পলেস্তারা খসে যাওয়া, রং উঠে যাওয়া, বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ না করা, ভালোভাবে গ্রিল না লাগানো, জানালার গø­াস না লাগানো, দ্বিতীয়তলা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পিছনের দেয়ালে হোলসিম না দেয়ায় ভবন দু’টি অরক্ষিত হয়ে পড়ায় যে কোন মূহুর্তে দূর্ঘটনায় ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। বিদ্যালয়ের ভবন সংকটে দু’টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা এক রকম বাধ্য হয়ে ভবন দু’টিতে ঝুঁকি নিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ক্লাশ চালিয়ে যাচ্ছেন।

            বিদ্যালয় দু’টি হচ্ছে- উপজেলার পেড়িয়া ইউনিয়নের বড়স্বাঙ্গিশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মৌকরা ইউনিয়নের বিঞ্চপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এনিয়ে বড়স্বাঙ্গিশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহেনা আক্তার উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে অভিযোগ করেও এখনো কোন প্রতিকার পাননি বলে জানান। এদিকে, বিঞ্চপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষা অফিসার মিনহাজ উদ্দিন সরেজমিনে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে বিদ্যালয়ের অসম্পূর্ণ এবং নিম্নমানের কাজের অভিযোগ এনে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসমাইল হোসেনের নিকট অভিযোগ করেন। ইসমাইল হোসেন সরেজমিনে ভবনটি পরিদর্শন করে নিম্নমানের কাজ ও অসম্পূর্ণ ভবন নির্মাণের সত্যতা পান।

            জানা গেছে, সাব ঠিকাদার উপজেলা ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক সুমন ভবন দু’টির নিম্নমানের কাজ এবং অসম্পূর্ণ কাজ রেখে ক্ষমতার দাপটে ইতোমধ্যে ভবন দু’টির নির্মাণ কাজের সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছেন।

            বিঞ্চপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে কাঠের দরজার ভার্নিস নেই। জানালার গø­াস লাগানো হয়নি। জানালার স্টিলের সিটগুলো ফাঁকা। ফলে বাইরের ছেলে-মেয়ে সহজে বিদ্যালয়ের কক্ষের ভিতরে ঢুকে শিশুদের খেলনা সামগ্রী, হোয়াইট বোর্ড, মার্কার কলম ও ফুলের টব নিয়ে যায়। বিদ্যালয়ের বারান্দা এবং প্রত্যেকটি কক্ষের ভিতরের ফ্লোর ইট, বালু ও সিমেন্ট উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতে দ্বিতীয় তলার নিরাপত্তা দেয়ালে হোলসিম না লাগানোতে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শিশুদের অসাবধনতাবশত পিছন দিয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া হোলসিম না থাকায় বাইরের লোকজন প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ওয়াশ বø­কের পাইপ নষ্ট করে ফেলছে। বিভিন্ন কক্ষের ভিতরের দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়তলা উঠতে সিঁড়িগুলোর ইট, বালু, সিমেন্ট উঠে খারাপ অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। বিদ্যালয়টির পুরো ভবনে কাজের কোথায়ও কোন ফিনিশিং দেখা যায়নি। এছাড়া ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার নিরাপত্তা গ্রিল না থাকায় বিদ্যালয়টি একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। নির্মাণের গত আড়াই বছরের মাথায় বিদ্যালয়টিকে একটি পরিত্যাক্ত ভবন মনে হয়। সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসমাইল হোসেন গত ফেব্রæয়ারী মাসে বিদ্যালয়টির নিম্নমানের কাজের অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এর সত্যতা পান। এখানেই শেষ। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত চার মাসেও এর সুফল পাননি বলে জানান।

            এদিকে অন্য এক ঠিকাদারের মাধ্যমে দ্বিতীয় তলায় প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রধান শিক্ষকের জন্য একটি আলাদা কক্ষ নির্মাণ কাজও অসমাপ্ত অবস্থায় এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা যায়।

            অন্যদিকে,একই ঠিকাদারের অধীনে নির্মিত উপজেলার বড়স্বাঙ্গিশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিরও নতুন ভবনের বেইস থেকে মূল পিলারে ফাটল সৃষ্টিসহ ভবনের বিভন্ন কক্ষে ফাটল সৃষ্টি, বারান্দার নিচে ফাটল, বৈদ্যুতিক লাইন এবং সরঞ্জাম খোলা, ভবনের রং উঠে যাওয়া, ছাদ এবং বারান্দার পলেস্তারা খসে যাওয়াসহ ছাদের দরজা ভাঙ্গা অবস্থায় থকতে দেখা যায়। ভবনটির দিকে তাকালে বুঝাই যাবে না, গত আড়াই বছর পূর্বে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। আড়াই বছর পূর্বে ভবনটির নির্মাণ শেষ হলেও নির্মাণ কাজে অসঙ্গতি থাকায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ভবন বুঝে নেননি। ২০২৩ সালের ৮ই আগষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহিনা আক্তার বিদ্যালয় ভবনের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভবন বুঝিয়ে না দেয়া নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, ভবনের রং এর কাজ শেষ করা হয়নি। প্ল­াষ্টার এখনো বাকি রয়েছে। ছাদ এবং মেঝেতে জুতার সাথে প্ল­াষ্টার উঠে যাচ্ছে। গø­াস সব লাগানো হয়নি। গ্রিলগুলো খুব নিম্নমানের। বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়নি। মেঝে ফিনিশিং দেয়া হয়নি। ছাদের দরজা লাগানো হয়নি। ওই সময়ে অভিযোগ করার পর সাবেক সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আশরাফুল হক ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।

            সরেজমিনে বড়স্বাঙ্গিশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনটির মূল পিলারে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। ভবনের বারান্দার নিচে ফাটল, বারান্দা এবং ছাদের পলেস্তারা খসে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি এবং স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা দেখা যায়। সিঁড়িগুলো খুব নড়বেড়ে অবস্থায় দেখা যায়। ছাদে উঠলে ভবনটি দুলতে থাকে। ভবনের রং উঠে বিবর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। ছাদের সাথে একটি কক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম লাগানো হয়নি। ভবনের বিভিন্নস্থানে ফুটো দেখা যায়। পা এবং হাতের খসায় ছাদের পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে। ভবনের পিছনে মাটি ফেলা হয়নি। ভবনের পিছনে এবং উপরে-নিচে ভালোভাবে রং করা হয় নাই। ভবনের সম্পূর্ণ কাজটি দায়সারাভাবে শেষ করা হয়েছে। ভবনটি যে কোন মূহুর্তে ধ্বসে পড়ে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। ভবনটিতে ঢুকলে মনে হবে না ভবনটি নতুন নির্মিত হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহিনা আক্তার ভবনটিতে ফাটল সৃষ্টিসহ নির্মাণ কাজে অসঙ্গতি থাকায় ভবনটি নির্মাণের ২ বছরেও ভবনটিতে উঠেননি। পরে শ্রেণী কক্ষ সংকটে এক রকম বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নিচ্ছেন।

            বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শাহরিয়ার ও মহিমা বলেন, বিদ্যালয়ের ছাদে পা দিলে ভবন টলমল করে উঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষক বলেন, ঠিকাদার ও উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে এবং অসমাপ্ত কাজ রেখে ঠিকাদার বিল উত্তোলন করে চলে যায়। বিদ্যালয়ের শ্রেণী সংকটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে বাধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নিতে হচ্ছে।

            বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহিনা আক্তার স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, এল.জি.ই.ডির তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন আমাকে ভবন বুঝিয়ে না দিয়ে এবং আমার প্রত্যয়নপত্র নকল করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ভবন নির্মাণের সম্পূর্ণ বিল এবং জামানত পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে।

            তিনি আরো বলেন, বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ চলমান অবস্থায় এল.জি.ই.ডির তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুনকে কাজের অসঙ্গতি নিয়ে মৌখিভাবে জানাই এবং মুঠোফোনে ছবি পর্যন্ত প্রেরণ করি। আমি উপজেলা প্রকৌশলীকে সরেজমিনে ভবন নির্মাণ কাজ দেখে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বিল প্রদান করতে অনুরোধ করি। পরে উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে ওনার কার্যালয়ে দেখা করলে ওনি জানায়, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিল এবং জামানত উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

            তিনি আরো জানান, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ইসমাইল হোসেন আমাকে মুঠো ফোনে ফোন করে ভবনটির অবস্থা জানতে চান। আমি ওনাকে ভবনটি বর্তমান অবস্থা জানানোর পর তিনি সাবেক সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আশরাফুল হককে ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য বিদ্যালয়ে পাঠান। তিনি ভবনটি পরিদর্শন করে ছবি এবং ভিডিও করে নিয়ে যান। বর্তমানে ভবনে ফাটল সৃষ্টি হয়ে সিঁড়ি থেকে ভবনটি আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ছাদের এক ইঞ্চি পরিমাণ কংক্রিট উঠে যাচ্ছে। ভবনটির বাইরেও একই অবস্থা। ভিতরে কি অবস্থা রয়েছে। আল্লাহ ভালো জানেন। ভবনটি ধ্বসে শিক্ষার্থীদের হতাহতের আশংকা রয়েছে।

            ভবনটির নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে, ওশান এন্টারপ্রাইজ। স্বত্তাধিকারী হচ্ছেন, আবুল খায়ের সেলিম। ঠিকানা হচ্ছে, সিরাজগঞ্জ। মূল ঠিকাদার কাজ না করলেও নাঙ্গলকোট উপজেলা ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক সুমনসহ তার সহযোগী অনেকে কাজটি করার সাথে যুক্ত রয়েছেন বলেন স্থানীয়রা জানান।

            উপজেলা প্রকৌশলী অহিদুল ইসলাম সিকদার বলেন, বিদ্যালয় দু’টি আমার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে নির্মিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমার নিকট কেউ অভিযোগ করে নাই। অভিযোগ পেলে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

            উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, বিঞ্চপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণে খুব নিম্নমানের কাজ হয়েছে। বিদ্যালয়টি খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বড়স্বাঙ্গিশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো দেখা হয়নি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। বিদ্যালয় দু’টির অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট আকারে আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

            উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বলেন, বিদ্যালয় দু’টির বিষয়ে আমার জানা নেই। উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলে বিষয়টি আমি দেখব।

Share This