বুধবার, ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ইসরায়েল বনাম ইরান: সংঘাতের পঞ্চম দিনেও হামলা-পাল্টা হামলা

ইসরায়েল বনাম ইরান: সংঘাতের পঞ্চম দিনেও হামলা-পাল্টা হামলা
৩৫ Views

ইসরায়েল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ইরানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, পারমাণবিক স্থাপনা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র। গতকাল মঙ্গলবারও ইসরায়েল ইরানের একজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইরানও হামলা চালাচ্ছে।

সংঘাতের পঞ্চম দিনেও উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। ইরান ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অপারেশন পরিকল্পনা কেন্দ্রে হামলার দাবি করেছে। ইসরায়েল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও, দেশটির হার্জলিয়া শহরের একটি ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে হামলার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম।

হতাহত ও লক্ষ্যবস্তু

গতকাল ইরানের যে সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করা হয়েছে, তার নাম আলী সাদমানি। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) খাতাম আল-আনিবিয়া শাখার প্রধান। সাদমানিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ বলে জানিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ নিয়ে পাঁচ দিনে ইরানের সেনাপ্রধান ও আইআরজিসির প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। ইরানের কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন। হামলায় ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গতকাল জানিয়েছেন, দেশটির আরও ১০টি পারমাণবিক লক্ষ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাগুলোকেও। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। এছাড়াও ইরানের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়, গ্যাসক্ষেত্র, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, বিমানবন্দর ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক।

হুমকি ও বিস্ফোরণ

প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎজ আয়াতুল্লাহ খামেনিকেও হত্যার হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইরানের প্রতিবেশী দেশের স্বৈরশাসকের সঙ্গে কী হয়েছিল, তা স্মরণ করতে পারেন খামেনি।’ এই স্বৈরশাসক বলতে তিনি ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যাকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং ২০০৬ সালে ফাঁসি দেওয়া হয়।

গতকাল সারাদিন ও রাতে ইরানের রাজধানী তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রাতে হামলা হয় ইস্পাহান প্রদেশেও। সোমবার মধ্যরাতে তেহরানের পূর্বাঞ্চলে বিস্ফোরণের পর ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ সময় শহরটি থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সোমবার ভোরে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলায় তখন পর্যন্ত দেশটিতে অন্তত ২২৪ জন নিহত হন। তবে গতকাল ইরানের কাশান শহরে আরও তিনজন নিহত ও চারজন আহত হন বলে জানায় দেশটির সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ। এছাড়া ইরানের লোরেস্তান প্রদেশে ২১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন খোররামাবাদ শহরের মেয়র রেজা সেপাহবান্দ। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবির ভবনে সোমবার রাতে হামলার পর সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে আইআরআইবির তিনজন কর্মী নিহত হয়েছেন। ক্রমবর্ধমান হতাহতের সংখ্যা বিবেচনায় ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সায়েদ সাজ্জাদ রাজাভি ছুটিতে থাকা সব চিকিৎসক ও নার্সকে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরতে বলেছেন।

ইরানের পাল্টা আক্রমণ ও বেসামরিকদের পলায়ন

গতকাল রাতে ইরানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা ‘শত্রুপক্ষের ২৮টি আকাশযান’ ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী ড্রোনও রয়েছে। এর আগে তেহরান ইসরায়েলের কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছিল।

পাঁচ দিন ধরে চলা তেহরানে হামলায় শহরটির বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী সাধারণ লোকজনকে হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর আশপাশের এলাকা থেকে সরে যেতে বলেছে। এরই মধ্যে আবার সোমবার তেহরানের বাসিন্দাদের শহর ছাড়তে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে। তেহরানের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, তিনি তেহরান ছেড়ে যাচ্ছেন, শহরটি এখন ফাঁকা লাগছে, শুধু যাদের যাওয়ার জায়গা নেই, তারাই রয়ে গেছেন।

তেল আবিব-জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত এবং সংঘাত কমানোর আহ্বান

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট জানিয়েছে, ইরান গতকাল ও আগের দিন রাতে ইসরায়েলের চারটি স্থানে হামলা চালিয়েছে। সোমবার রাতভর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে সাইরেন বাজছিল। তেল আবিব, জেরুজালেম ও হার্জলিয়া শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, এ সময় হাজার হাজার ইসরায়েলি একাধিকবার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান।

গতকাল হার্জলিয়া শহরে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সামনে আসে। এদিন এ শহরেই ‘স্পর্শকাতর’ স্থাপনায় হামলার খবর জানিয়েছিল ইসরায়েল। হামলায় হার্জলিয়ার আটতলা একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে একটি বাসে আগুন ধরে যায়। গতকাল রাতেও তেল আবিবে হামলা হয় বলে জানিয়েছে ইসরায়েল বাহিনী। তাদের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ২৪ জন।

আল-জাজিরার খবর অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৪ হাজার আবেদন পড়েছে। ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এ আবেদন করেছেন। এছাড়া গত কয়েক দিনে ইরানের হামলায় ইসরায়েলে জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায়ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা

ইরানের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর থেকে হামলা থামানোর বিষয়ে এখনো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি ইসরায়েল। তবে আগের তুলনায় আলোচনায় ফেরার বিষয়ে ইরান কিছুটা নমনীয়। সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পরিধি বাড়াতে চায় না তার দেশ। পরে গতকাল ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইরান কূটনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এছাড়া আলাদা পাঁচটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে চাপ দেন, সে জন্য দেনদরবার করতে ওমান, কাতার ও সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তেহরান। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় আরও ছাড় দেবে ইরান।

সংঘাত থামাতে বিভিন্ন দেশও তৎপরতা দেখাচ্ছে। গতকাল দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজেদ আল-আনসারি। তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাবেন তারা। সংঘাত কমানোর আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি-৭।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধে রাশিয়া মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত বলে গতকালও জানিয়েছে ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এমন ইচ্ছার কথা জানান। এদিকে সংঘাত শুরুর পর গতকাল প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় অবস্থানকালে তিনি বলেন, সব পক্ষকে দ্রুত এ সংঘাত প্রশমনে কাজ করতে হবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের ‘সত্যিকারের অবসান’ চান তিনি, যা যুদ্ধবিরতির চেয়েও কার্যকর হবে। এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে পাঠাতে পারেন।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সেখানে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস কার্ল ভিনসন রয়েছে। বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজও মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। এর বাইরে আরব সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা রয়েছে। এসব জাহাজ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম।

মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসার কথা ট্রাম্পের। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তি সামরিক শক্তি মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প।

তবে এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সরাসরি জড়াতে চায় না বলে মনে করেন দোহাভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক আদেল আবদেল। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘সংঘাত বাড়তে পারে। আমি মনে করি, এতে ট্রাম্প যোগ দেবেন না এবং সংঘাত হয়তো কমাতে চাইবেন। কারণ, সংঘাতের কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে স্বার্থ ট্রাম্পের রয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে পূরণ হবে না।’

Share This