শুক্রবার, ৪ঠা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব

হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব
Views

            আলম শামস\ হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন ও সুখ-দুঃখময় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। মহররম আরবি শব্দ। এ শব্দটি সম্মানিত, পবিত্র ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। মহররম মাসের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। আশুরা দিবসের কারণে মহররম মাস বেশি ফজিলতপূর্ণ। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত আশুরাকে আরো স্মরণীয় করেছে। মূলত হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়েছে। এ সনের গণনা হয় চাঁদের হিসাবে। এ জন্য হিজরিবর্ষকে চান্দ্রবর্ষও বলা যায়। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর পবিত্র মক্কায় ইসলাম বিরোধীদের নির্যাতনের মুখে নবুয়তের ১৩তম বছরে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তৎকালীন ইয়াসরিবে (আজকের মদিনায়) হিজরত করেন। অবশ্য এরও কয়েক বছর আগে থেকে নবীজির (সা.) নির্দেশে অনেক সাহাবি একা, সপরিবারে ও কোনো কোনো পর্যায়ে কাফেলাসহ প্রথমে আবিসিনিয়ায় ও পরবর্তী সময়ে ইয়াসরিবে হিজরত করেন। সংকটাপন্ন জীবন ও ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষায় মুসলিমরা ঘর-বাড়ি ও স্বজন ত্যাগ করে হিজরতের পথ বেছে নেন। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়ানোর যুগের সূচনা হয়। ইসলামের বিকাশ ও জয়যাত্রার ইতিহাসে হিজরতের তাৎপর্য তাই ব্যাপক। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুকের (রা.) শাসনামলে রাষ্ট্রীয় কাজের সুবিধার্থে সন গণনার প্রয়োজন হলে এই হিজরত থেকেই ইসলামী সন গণনা শুরু করার নির্দেশ জারি করেন।

            মুসলমানদের কাছে হিজরি সন অন্য যে কোনো সনের মতো নয়। মুসলমানরা এ সনের হিসাবে নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজের মতো ইবাদতগুলো পালন করে থাকে। আর এসব পালন করতে গিয়ে তাদের অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়। মুসলমানের জীবনে কোনো ভোগ নয়, ত্যাগই তার সাধনা-এটাই মনে করিয়ে দেয় এই সন। কারণ হিজরি সনের কোনো মানুষের জন্ম বা মৃত্যুকে উপলক্ষ করে শুরু হয়নি। তা শুরু হয়েছে হজরত রাসুলুল­াহ (সা.) ও তারা সাহাবিদের জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করার মতো ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখানোর মধ্য দিয়ে। সে হিসেবে বলা যায়, হিজরি সনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো জীবনে ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো।

            মুসলিম জীবনে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন, যার সাথে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবেমিরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হিজরি সনের পহেলা মাস মহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে হাজির হয় ঠিক, কিন্তু হিজরি সনের নব আগমন উপলক্ষে কোনো বিশেষ আয়োজন নেই, উৎসব নেই।

            ঈসায়ী নববর্ষ কিংবা বাংলা নববর্ষের আগমনে আমাদের দেশের সংস্কৃতি প্রেমিকরা সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চায় মেতে ওঠে। এতে ইসলামী বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করা হয় না। তথাকথিত সংস্কৃতিপ্রেমীদের সাথে সাথে আমাদের একশ্রেণির তরুণ-তরুণী নববর্ষ উদযাপনের নামে অশ্লীলতা ও বেলেল­াপনায় গা ভাসিয়ে দেন। ঈসায়ী নববর্ষ কিংবা বাংলা নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব তথা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয় এবং হিজরি নববর্ষের প্রতি অবহেলা দেখে মনে হয় হিজরি নববর্ষের যেন আমাদের প্রয়োজনই নেই। অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করা ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। যাক, এখন আসি মূল কথায়। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে তন্মধ্যে হিজরি সন অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসুল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল­াহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা।

            খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সংবলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোনো চিঠি কোন দিনের তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রত বোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হজরত আবু মুসা আশআরীর চিঠি পেয়ে হজরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহŸান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামি তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে ওই সভায় ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামি সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করেন রাসুল (সা.)-এর জন্মের মাস রবিউল আওয়াল থেকে বর্ষ শুরু করার। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসুলের ওফাতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। অন্যান্যের মতে হুজুর (সা.)-এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ করা হোক। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত উমর (রা.) বললেন, হুজুর (সা.)-এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিষ্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্য হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য। এ সম্পর্কে রাসুলের বাণী, ‘তোমরা ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের বিরোধিতা করো।’ (বুখারি ও আবু দাউদ শরিফ)।

            আর অপরদিকে হুজুর (সা.)-এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে হুজুর (সা.)-এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলামবিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হজরত ওমর (রা.)-এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) এক বাক্যে সহমত পোষণ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি দিনপঞ্জী গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ। মোদ্দা কথা, আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হিজরি সনের গণনা শুরু হয়। এটাই ছিল হিজরি সনের প্রেক্ষাপট।

            মহান আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম। (সুরা তাওবাহ : ৩৬)। আর এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মহররমের দশম তারিখে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও এই দিনে আরও অনেক ঘটনা ঘটবে। মহররমের ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নফল রোজা। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুল (সা.) কে এই দিন (আশুরার) এবং এই মাসে রমজানের রোজার চেয়ে অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। (মিশকাত শরিফ)। রাসুলুল­াহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি শরিফ)।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

(ইনকিলাবের সৌজন্যে)

Share This

COMMENTS