‘অনৈসলামিক’ সরকারের বিবেচনায় ক্ষতিকর দিক এবং ইসলামী চেতনাঃ


অধ্যক্ষ ইয়াছিন মজুমদারঃ রাষ্ট্র, ভাষা ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য ইসলাম পরিপূর্ণ একটি জীবন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো: একটি শাশ্বত, চিরন্তর ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এই বিধান সার্বজনীন, যুগোপযোগী ও জীবন্ত। কুরআনুল কারীমের শাশ্বত শিক্ষা, রাসূলুলাহ্ (সা) এর অনুপম আদর্শ এবং সাহাবীগণ (রা)-এর অত্যুজ্জ্বল জীবনচার ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এই মহান ধর্মের সার্বজনীনতা, উদারতার দৃষ্টিভঙ্গি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অসাধারণ মানবিকতা, অতুলনীয় কল্যাণধর্মী এবং জীবন্ত শাশ্বত ও অন্তর্মুখী এক জীবন ব্যবস্থাটাই হলো ইসলাম। ইসলাম বস্তুবাদী জীবনদর্শন নয়। ইসলাম মানুষ ও আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে শিখায়। ইসলাম মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর মাখলুকাতের সাথে সম্পৃক্ত করে, সমন্বয় সাধন করে বস্তুগত ও আধ্যায়ত্মিকভাবে।
কিন্তু সমাজে কিছু লোক তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে সরলমনা জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে এবং প্রতারণা করছে। কখনও কখনও নানা ফতোয়া জারী করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এমনকি কারো কারো দ্বারা আল্লাহ্-রাসূলের বাণীর ব্যাখ্যা করা হচ্ছে মনগড়াভাবে। ইসলামের কোনো কোনো বিষয়ে এবং চার মাযহাব সম্পর্কেও ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। হানাফী মাযহাব সম্পর্কে আপত্তিকর বক্তব্য প্রদান করেও ধর্মীয় সংহতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা হচ্ছে। হাদীসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে ধর্মীয় বিভেদ-বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিবাদ-বিসংবাদ প্ররোচিত করা হচ্ছে। এতে করে ধর্মীয় শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।
এসবের আলোকে নিম্নে ‘অনৈসলামিক’ সরকারের বিবেচনায় কতেক ক্ষতিকর দিকসমূহ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো:
১) রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলা সুন্নাত। আমাদের দেশে ইংরেজ আমলে প্রথম যখন যানবাহন চলাচল শুরু হয়- তখন ইংরেজরা অনৈসলামিক সরকার ছিলেন। তারা তাদের নিয়মানুযায়ী বাম দিক দিয়ে চলাচলের নিয়ম শুরু করেন। এখন আমরা সুন্নত তরক করে বাম দিক দিয়ে চলছি! এটাকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, সুন্নত তরক করছি- এ বিষয়টি অনুভূতিতেই নেই, বরং ডান দিক দিয়ে চললে বলা হবে রং সাইডে, মানে সুন্নতের বিষয়টিকে রং অর্থাৎ ভুল বলা হবে। আরব দেশে গিয়ে দেখুন, সেখানে আগ থেকেই ইসলামী সরকার ছিল বিধায় তাদের রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলাচলের নিয়ম বিদ্যমান ছিলো।
২) আলিমরা বলেন পূজার বেদির মতো একটি স্থানকে পবিত্র মনে করে সেখানে ফুল দিয়ে সম্মান দেখানো শিরক, কারো কারো মতে বিজাতীয় সংস্কৃতি হওয়ার কারণে কবিরা গুনাহ। কিন্তু আমাদের নাগরিকরা, ছাত্রছাত্রীরা এটাকে উৎসাহের সাথে এবং কোন ধরনের পাপ হতে পারে এই অনুভূতিহীন ভাবেই তা করে যাচ্ছে।
৩) ছবি ঝুলানো, ছবি ঝুলিয়ে সম্মান দেখানো, ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী বৈধ নয়, কিন্তু তা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে, কেউ মারা গেলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন বিজাতীয় সংস্কৃতি, এ বিষয়টিও স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
৪) কোনো অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াত তারই সাথে গীতা পাঠ, তারই সাথে ত্রিপিটক পাঠ- এভাবেই কোরআনের সাথে অন্যগুলোকে সামঞ্জস্য করার রীতিটি প্রচলিত হয়ে গেছে।
৫) ফরায়েজ তথা ইসলামের বিধান মতো ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের নিয়মে প্রথম হস্তক্ষেপ করেছিল পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান, এতে আলেমরা ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বাচনে আইয়ুব খানকে ভোট না দিয়ে মহিলা প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেয়। কিন্তু সে পরিবর্তিত আইন এখনো বিদ্যমান আছে এবং তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
৬) নারীদের আউট ডোরে ফুটবল খেলায় লাগিয়ে দেয়া। এটা ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এখন বরং ইনডোরে নিতে গেলেই মৌলবাদী, প্রগতি বিরোধী তকমা পেতে হবে।
৭) দেব-দেবির প্রতিকৃতি ও মুর্তির ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা, মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুসলমানদের পরিবার পরিজন নিয়ে যোগদানকে দোষের মনে না করা।
৮) কোন বিশেষ ব্যক্তিকে দাফন করতে সন্মান দেখাতে বাদ্যযন্ত্র বাজানোসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ করা।
এভাবে অনৈসলামিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে ইসলাম বিরোধী কিছু নিয়ম এমনভাবে প্রচলিত হয়ে যাবে- যা অন্যদের কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। পরবর্তী কোনো ইসলামী সরকার এলেও তা সহজে পরিবর্তন করতে পারবে না। যেমন এখন যে কোনো ইসলামী সরকার আসুক বাংলাদেশে রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলাচলের নিয়ম তিনি করতে পারবেনই না। যেমন কামাল আতাতুর্ক যখন তুরস্কে ধর্মনিরপেতা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন- তিনি যে নিয়মগুলো করেছেন তার সবগুলো আজও পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। হয়তো ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তন হবে, বহু বছরও লেগে যাবে।
ওদিকে, তাবলীগের ভাইয়েরা মনে করছেন, মানুষগুলোকে সংশোধন করে নিলেই ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। পীর সাহেবরাও মনে করছেন মানুষের আত্মিক সংশোধন হলেই ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। উনারা কখনো ভাবেননি যে, কত দিনে তা করতে পারবেন কিংবা আদৌ করতে পারবেন কিনা? ততদিনে অনৈসলামিক সরকার এমন অনেক নিয়ম করে ফেলবে যা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এজন্য ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে যদি ইসলামী সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাহলে ইসলামিকরণ না করলেও অন্তত ইসলাম বিরোধী কোন নতুন নিয়ম করা হবে না এটাই আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে বলে আশা করছি।
লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা