থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৩৩ জন নিহত, ঘরছাড়া ১.৭ লাখের বেশি মানুষ


থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে চলমান সীমান্ত উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে। গত তিন দিন ধরে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। সংঘর্ষের কারণে দুই দেশ মিলিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। জাতিসংঘ ও আসিয়ান জোটের পক্ষ থেকে দুই দেশকে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে থাইল্যান্ডের সারিন প্রদেশ সংলগ্ন সীমান্ত এলাকার Ta Muen Thom এবং Ta Krabey নামের দুইটি প্রাচীন মন্দিরের কাছে। গত ২৩ জুলাই বিকেলে থাই সেনাবাহিনীর একটি দল সীমান্ত টহলে গেলে একটি মাইন বিস্ফোরণে পাঁচ সেনা আহত হন। থাইল্যান্ড দাবি করে, এই বিস্ফোরণ ছিল কম্বোডিয়ার সেনাদের পাতা ফাঁদ। পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে শুরু হয় গুলি বিনিময়, যা পরে আর্টিলারি ও ড্রোন হামলায় রূপ নেয়।
Al Jazeera ও Reuters এর খবরে বলা হয়, সংঘর্ষে থাইল্যান্ডে ২০ জন এবং কম্বোডিয়ায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দুই দেশেরই সেনা সদস্য ও সাধারণ নাগরিক রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে, যেখানে একসাথে একটি আর্টিলারি শেলের আঘাতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সংঘর্ষের ফলে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সীমান্তের দুই পাশেই। থাইল্যান্ডে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ও কম্বোডিয়ায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বহু গ্রাম এখন প্রায় জনশূন্য। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অন্তত ৮৫০টি স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য জরুরি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে শুরু করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
Reuters-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংঘর্ষে ব্যবহৃত হয়েছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, যার মধ্যে আছে আর্টিলারি, রকেট লঞ্চার, যুদ্ধবিমান ও ড্রোন। থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী আটটি জেলায় জারি করেছে সামরিক আইন (মার্শাল ল)। অপরদিকে কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীও সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরি বৈঠকে বসেছে এবং দুই দেশকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম—এই তিনটি আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে দুই পক্ষকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম নিজে এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ এবং ঐতিহাসিক মন্দির এলাকাগুলোর মালিকানা নিয়ে টানাপড়েন। ২০১১ সালেও এমন একটি সংঘর্ষ হয়েছিল, যার রেশ কাটেনি আজও। এবার সংঘর্ষ আরও বিস্তৃত এবং সহিংস রূপ নিয়েছে। যদি দ্রুত যুদ্ধবিরতি না হয়, তাহলে এই উত্তেজনা পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা যুদ্ধ নয়, শান্তি চায় এবং থাইল্যান্ডকে উস্কানিমূলক তৎপরতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। অপরদিকে থাইল্যান্ড জানিয়েছে, তারা কেবলমাত্র আত্মরক্ষার্থেই প্রতিরোধ করছে এবং দেশের সীমান্ত রক্ষা করা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, সংঘর্ষ চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
এখন আন্তর্জাতিক চাপ, কূটনৈতিক উদ্যোগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই সংঘর্ষ থামানো সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়।