আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী মানেই গ্রেপ্তার; অপরাধী হোন বা না হোন! -আইস-এর পরিচালক টড লায়ন্স


জান্নাতুল ফেরদৌস পুষ্প:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লায়ন্স জানিয়েছেন যে, যারা অবৈধ অভিবাসী নিয়োগ দেয়, এমন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অবস্থান করে থাকেন, তা তিনি অপরাধী হোন বা না হোন, তাকেও গ্রেফতার করা হবে।
গত ২০শে জুলাই নিউইয়র্কের সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন কর্মক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগে অব্যাহতভাবে অভিযান চালাবে। এই ধরণের কার্যক্রমে কোনও নির্বাহী আদেশ দ্বারা নিষেধাজ্ঞা নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
লায়ন্স বলেন, কিছু কোম্পানি শিশু শ্রম ব্যবহার করছে এবং মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত, যা মোটেও ‘ভিকটিমহীন অপরাধ’ নয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু অবৈধভাবে কাজ করা ব্যক্তিদের উপরই নজর দিচ্ছি না; সেই সাথে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর মধ্যে যারা এই শ্রমিকদের শোষণ করছে, তাদের প্রতিও লক্ষ্য করছি। এই লোকগুলো ভালো জীবনের আশায় এসেছিল।’
লায়ন্স জানান, তাদের অগ্রাধিকার হবে- যেসব অবৈধ অভিবাসী যারা গুরুতর অপরাধের জন্য দন্ডিত হয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার ও বিতাড়িত করা। তবে, দন্ডিত না হলেও, যে কেউ অবৈধভাবে থাকলে তাকেও আইস’র লক্ষ্যবস্তু করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমিত সম্পদ থাকলেও, আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে এসব গ্রেফতার করছি এবং এখানেই গ্রেফতারের হার বাড়ছে।’
সিবিএস নিউজকে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘যদি আমরা কাউকে পাই যে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে, তাহলে আমরা তাকে গ্রেফতার করবো।’ মার্চে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হওয়ার পর এটি ছিল তার প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাৎকার।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, অবৈধ অভিবাসীদের গণবিতাড়ন হবে তার অন্যতম অগ্রাধিকার। তিনিসহ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, গণহারে অবৈধ অভিবাসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর পরিণতি বয়ে আনবে।
এ ব্যাপারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ট্রাম্প বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিল, দক্ষিণ সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক গ্যাং ও মাদকচক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা। এই আদেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিবাসী সংগঠন, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (অঈখট) এবং অন্যদের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এছাড়া, প্রশাসনের সীমান্ত বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টম হোম্যান বলেছেন, অগ্রাধিকার থাকবে অপরাধে জড়িত অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে দেয়া। তবে অভিযান চলাকালীন অন্যান্য অবৈধ অভিবাসীর গ্রেফতারও একটি ‘বাস্তবতা’ বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
ওদিকে, চলতি বছরের শুরু থেকেই হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ জানিয়েছে, যারা আইসিই অভিযানে জড়াতে চান না, তারা কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের অ্যাপ ব্যবহার করে স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করলে ১ হাজার ডলার বোনাস পাবেন এবং বৈধভাবে পুনরায় আসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। টড লায়ন্স আরো বলেছেন যে, ‘আইসিই সবসময় ভয়ংকর অপরাধীদের টার্গেট করে থাকে। তবে বর্তমান প্রশাসনের অধীনে আমরা খুলে দিয়েছি পুরো ইমিগ্রেশন পোর্টফোলিও’।
এখানে বিশেষ ভাবে আরও উল্লেখযোগ্য যে, অবৈধ অভিবাসী গ্রেফতারের পরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের চলমান কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার অভিপ্রায়ে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) থেকে অবসরগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের পুনরায় চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-প্রশাসন অভিনব একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
অর্থাৎ গত ৫ বছরের মধ্যে যারা অবসর নিয়েছেন, তার মধ্যে যারা এখনো কাজ করতে উপযোগী তাদের কাছে প্রেরিত ই-মেইলে (এমনকি আইসের ওয়েবসাইটের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও) উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১লা আগস্টের মধ্যে যারা আবেদন করবেন, তারা নগদ ৫০ হাজার ডলারের বোনাস পাবেন। এছাড়া, অবসরভাতা (পেনশন)-এর পাশাপাশি পুনরায় যোগদানের বেতন-ভাতাও পাবেন। অবৈধভাবে বসবাসরতদের গ্রেফতারের অভিযান ত্বরান্বিত করতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তার বিকল্প নেই-এমন প্রত্যাশায় এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, চলতি জুলাই মাসে কংগ্রেসে পাস হওয়া একটি বিল অনুযায়ী আইসের বাজেট তিনগুণেরও বেশি হয়েছে। এজন্য আরো ১০ হাজার অফিসার নিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতারের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি গত ৬ মাসেও। এজন্যই যোগ্যতাসম্পন্ন অফিসার নিয়োগের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা রোবার্ট জে হ্যামার মনে করছেন, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অফিসার ছাড়া গ্রেফতার ও বহিষ্কারের ল্য অর্জন সম্ভব নয়। গত ৫ বছরের মধ্যে অবসরগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আইসের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে- ‘এটি আমাদের দেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং আপনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার খুবই প্রয়োজন। একটি কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষে আমরা গর্বের সঙ্গে আপনাকে আপনার দেশের সেবা করার জন্য উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছি।’ তদুপরি, ফেডারেল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একই কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা রোবার্ট জে হ্যামার আরো জানান, ‘আমরা আইসের সাবেক অফিসারদের প্রতি একটি জরুরি আহŸান জানাচ্ছি ‘অপারেশন রিটার্ন টু মিশন’-এ অংশগ্রহণের জন্য।’ এতে স্পষ্টভাবে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ বছরের মধ্যে আইস থেকে স্বাভাবিক নিয়মে অবসরগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে সক্ষম তারা ১লা আগস্টের মধ্যে সাড়া দিলেই ৫০ হাজার ডলারের বোনাস পাবেন। এছাড়া অবসর ভাতার সঙ্গে পুনরায় চাকরির বেতন-ভাতাও পাবেন।
ওদিকে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের দৈনিক গ্রেফতারের টার্গেট ৩ হাজার করলেও ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যে ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে গত ১৩ই জুলাই পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২৯৭ জন অবৈধ অভিবাসীকে। এ সংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে গড়ে ১১ জন। গ্রেফতারদের মধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে দেড় লাখের মতো। যে সংখ্যা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলের একই সময়ের চেয়েও কম। এ অবস্থায় বিব্রত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহবানে রিপাবলিকান শাসিত কংগ্রেসে আইনের বাজেট বৃদ্ধির বিল পাস হয়েছে। যদিও অভিনব এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তেমন কোনো সাড়া পাওয়ার তথ্য এ সংবাদ লেখা পর্যন্তও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী কেবল গুরুতর অপরাধী অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। গ্রেফতারদের তথ্য পর্যালোচনার পর মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত একাধিক সংস্থা ও থিংক ট্যাংক জানিয়েছেন, ৬৫ শতাংশের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো অভিযোগ নেই। তারা শুধু অভিবাসনের আইন লঙ্ঘন করেছেন, যা ফৌজদারি কোনো অপরাধ নয়। এ অবস্থায় সাধারণ আমেরিকানের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার তথ্যও সর্বশেষ কয়েকটি জনমত জরিপে উদঘাটিত হয়েছে। তাই অধিকাংশ মানুষ অভিবাসীদের কঠোর শ্রমে বিশ্বের সেরা দেশ আমেরিকায় কঠোর পরিশ্রমী অভিবাসীদের সঙ্গে নির্দয় আচরণকে আমেরিকার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী বলেও মনে করছেন।
তদুপরি, এবার মার্কিন ভিসাধারীদের জন্যও কড়া হুঁশিয়ারি জারি করা হয়েছে। নিয়মের ব্যত্যয় হলেই মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে ভিসা বাতিল। এমনকি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছেন, ভিসা কোনো অধিকার নয়; এটা কেবল একটা সুযোগই মাত্র। আর এই সুযোগের অপব্যবহার যারা করবে, তাদের ক্ষেত্রে নামবে শাস্তির খড়গ; কোনো রকম ছাড় দেয়া হবে না। এ সংক্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বা ভ্রমণরত বিদেশি নাগরিকদের উদ্দেশে কড়া হুঁশিয়ারি জারি করেছেন ভারতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকেও। এক বিবৃতিতে দূতাবাস জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বা বিদেশে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে ভিসা বাতিল হতে পারে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ চিরতরে বন্ধও হয়ে যেতে পারে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ ‘এক্স’ (পূর্বতন টুইটার)-এ প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেছে, ভিসা হলো একটি সুযোগ, অধিকার নয়! যদি আপনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে হামলা, পারিবারিক সহিংসতা বা অন্য কোনো অপরাধে গ্রেফতার হন, তাহলে আপনার ভিসা বাতিল হতে পারে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মার্কিন ভিসা পাওয়ার যোগ্যতা নাও থাকতে পারে! এমন ঘোষণার পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও অভিবাসন নীতিতে কঠোর অবস্থানে ফিরে গেছেন এবং বিদেশি নাগরিকদের অপরাধে জড়িয়ে পড়লে কঠোর শাস্তি ও বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত ২০শে জানুয়ারি থেকে গত ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১ লাখ ৪২ হাজারেরও বেশি মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দোকানে জিনিসপত্র চুরি (শপলিফটিং) ইত্যাদি অপরাধকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এমনকি তথাকথিত সামান্য অপরাধও বিদেশি নাগরিকদের জন্য স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে যেমন: ভিসা বাতিল, বহিষ্কার আদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপ্রবেশে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। উল্লেখিত বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে যে, বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে দোকানদাররা সন্দেহভাজনদের আটক করার অধিকার রাখেন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলাও দায়ের করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্পষ্ট করেছে যে, আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তি নিশ্চিত, বিশেষ করে বিদেশিদের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে সকল ভিসাধারীদের প্রতিও।
Ref: cbs/ thikana/ deshus.com