বৃহস্পতিবার, ৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোনাইমুড়ীর ঐতিহ্যবাহী মহেন্দ্র খালসহ অসংখ্য খাল প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের কবলে!

সোনাইমুড়ীর ঐতিহ্যবাহী মহেন্দ্র খালসহ অসংখ্য  খাল প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের কবলে!
৩২ Views

            আমিনুল ইসলাম মানিক\ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী মহেন্দ্র খালসহ মৌজা নকশায় চিহ্নিত খালসমূহ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের কবলে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিগত ৩০ বছর আগে থেকেই দখল-দূষণের কবলে হারিয়ে গেছে কয়েকশ’ বছর আগের খনন করা নোয়াখালী-সোনাইমুড়ী অঞ্চলের মহেন্দ্র খালসহ উপজেলার বিভিন্ন মৌজার সিএস জরিপি নকশায় চিহ্নিত খাল-দাঁড়াসহ বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের মাধ্যম খালসমূহ। খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় একের পর এক খাল দখল করে বাড়ি, বহুতল ভবন, বাগান, দোকান, কবরস্থান মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করেছেন। যার ফলে গত বেশ কয়েক বছর থেকে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, বন্যার সৃষ্টি হয়ে জনদুর্ভোগ দেখা দেয়। উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মাঝে-মধ্যে জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে সংস্কারসহ পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগের কথা শুনালেও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হয়না।

            এক সময়ের পানি প্রবাহ ও আন্তঃজেলা নৌ-চলাচল ও মালামাল পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল মহেন্দ্র খাল।  নোয়াখালী-সোনাইমুড়ী অঞ্চলের পাঁচশ’ বছরের সেই ঐতিহ্যবাহী মহেন্দ্র খাল অস্তিত্ব হারিয়ে দখলদারদের কবলে পতিত! সেচ প্রকল্পের আওতায় পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে নামসর্বস্বভাবে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো খননে গত ২ বছর আগে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, নোয়াখালী খাল খননের নামে চরম উদাসীনতার পরিচয়সহ সরকারি তহবিল ও খাল দখলকারীদের দালান, বাড়ি,  দোকান ইত্যাদি রক্ষায় ঠিকাদার ও স্থানীয় দালালের মাধ্যমে খালের মাটি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। দখলমুক্ত ও খনন কাজসহ প্রভাবশালীদের কবল থেকে খাল উদ্ধারে বরাবরই রাজনৈতিক প্রভাবের অজুহাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালী কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়।             সংশ্লিষ্ট দপ্তর, খালখেকোসহ স্থানীয় প্রভাবশালী মহল একীভূত ও আঁতাত করে বছরের পর বছর খাল দখলসহ সোনাইমুড়ী বাজারের বিভিন্ন ভবন, রেস্তরাঁ ও দোকানের ময়লা-আবর্জনা ফেলে সোনাইমুড়ী বাজারের উপর দিয়ে প্রবাহিত মহেন্দ্র খালের ভরাট করে অস্তিত্ব বিলীন করা হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ক’দিন হাঁকডাক দিয়ে এরপর খালখেকোদের সঙ্গে আপস-রফার মাধ্যমে যে যার অবস্থানে চুপচাপ থাকে। গত ২ বছর আগে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নামসর্বস্ব খাল খননের কাজ শুরু হলেও সোনাইম্ড়ুী অংশে মহেন্দ্র খালটি খনন করা হয়নি। বরং খালের দক্ষিণ পূর্বদিকে কাশিপুর ছাতারপাইয়া সংযোগ অংশে স্থাপনাগুলো রক্ষায় খালের নকশা পরিবর্তন করে ও কোনোরূপ কাজ না করেই খনন কার্যক্রম শেষ করে। নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় সোনাইমুড়ী-চাটখিল উপজেলার অংশে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯৭ কিলোমিটার নামসর্বস্ব খনন কাজের প্রকল্পে নকশা নমুনায় খাল খনন কর্মসূচি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সেচ প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় এই ঐতিহ্যবাহী মহেন্দ্র খালটি পাউবো’র নজরে ও দায়িত্বের বাইরে রেখে খালখেকোদের বহুতল ভবন ও স্থাপনা রক্ষার চাবিকাঠি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এই খাল খনন না করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ কার্যালয়ে দৌড়-ঝাঁপসহ লাখ লাখ টাকা উৎকোচের মাধ্যমে মহেন্দ্র খালটি খননে নকশার বাইরে রাখার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এখনও একই চক্র পাউবো’র অফিসে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। এই খালে পানি প্রবাহে বিঘœ ঘটায় গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উপজেলার প্রতিটি গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টিসহ পথঘাট ডুবে জন চলাচল ও স্কুলগামীদের স্কুলে আসা যাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এলাকার অনেক স্কুল মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতে হাঁটুসমেত পানি উঠে দুর্ভোগের সসৃষ্ট হয়েছে। মহেন্দ্র খালসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের মৌজা নকশায় চিহ্নিত কোনো খালেরই অস্তিত্ব ও নাব্যতা নেই। ফলে কৃষি মৌসুমে কৃষককুলের ফসল বুননে পানির অভাবে কৃষি কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

            শত শত হেক্টর ফসলি জমি আবাদের বাইরে থেকে যায়। উপজেলায় জলাবদ্ধতা ও বন্যার কবল থেকে মানুষকে রক্ষায় দ্রæততম সময়ে মহেন্দ্র খালের সোনাইমুড়ী অংশসহ উপজেলার বিভিন্ন খালের উপর জবর দখলকারীদের নির্মিত ভবন, দোকান ও অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা অপসারণে উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের জরুরি পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।

            সরজমিন অনুসন্ধানকালে বজরা ইউনিয়নের বারাহিনগর গ্রামের স্থানীয় কৃষক আবুল খায়ের, সফি উল্যাসহ অনেকেই বলেন, সিএস নকশার ২৮০ নং দাগে চিহ্নিত দেড়শ’ বছরের পুরনো খাল এক শ্রেণির প্রভাবশালীরা অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে ভরাট করে বাউন্ডারি ওয়াল, টিনের ঘর, বাগান ও কবরস্থান নির্মাণ করে জবরদখল করে আসছে। একই এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেন, লতিফ, রুবেলসহ অনেকেই জানান, বাজারের উপর দিয়ে প্রবাহিত খালের জায়গা দখল করে অনেকেই ভবন,  দোকানপাট, মার্কেট নির্মাণ করে খালের চিহ্ন বিলীন করে আসছে। এছাড়াও বজরা রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ইসলামগঞ্জ বাজার খাল পর্যন্ত আসা পানি প্রবাহ ও নৌ চলাচলের খালটির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। যা জবরদখলকারীদের বহুতল ভবনের নিচে পড়ে আছে। নাটেশ্বর ইউপি’র দিঘিরজান, আমিশাপাড়া বাজার, কাজীরখিল বাজার, আবিরপাড়া বাজার, চাষীরহাট, জয়াগ ইউপি এলাকায়, নদোনা ইউপি’র বাংলা বাজার, বারগাঁও ইউপি’র কাশীপুর বাজার,  সোনাপুর ইউপি, সোনাপুর বাজার, কালিকাপুর বাজার, কোটবাড়িয়া এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের খালসমূহ জবরদখলকারীদের দোকান-পাট ও বহুতল ভবনের নিচে চির নিদ্রায় পতিত! সচেতন মহল ও জনসাধারণের কাছ থেকে জানা যায়, খাল দখলকারীরা হাতেগনা ও সংখ্যায় নগণ্য, তাদের কারণে এলাকার লাখ লাখ লোক পানি বন্দি হতে হয়। তাদের কাছ থেকে খাল উদ্ধারসহ তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানার বিধান নিশ্চিত করলে খাল উদ্ধার করা সহজ হবে। এতে নতুন করে আর কেউই খালে অবৈধ বাঁধ,  দোকান, স্থাপনা ও বহুতল ভবন নির্মাণ করার সাহস পাবে না।                স্থানীয়রা আরও জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খালের পাড়ে দখলদারদের বিভিন্ন স্থাপনা, ইমারত রক্ষা করে অদৃশ্য ইশারায় সোনাইমুড়ী অংশে মহেন্দ্র খালসহ বিভিন্ন খাল খনন কাজ বাদ পড়ে।

            স্থানীয় একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, খাল দখল করে নির্মিত বিভিন্ন ইমারত, ভবন রক্ষায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সরকারি খালের জায়গাতে নির্মিত ভবনের প্রতি বর্গফুট ২/৩ হাজার টাকা হারে কোটি টাকার তহবিল গঠনের ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতন পৌরবাসীর অভিযোগ, খালের ওপর অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরি করে দখলে নেন প্রভাবশালীরা। যে কারণে মহেন্দ্র খালসহ উপজেলার বিভিন্ন খাল নামেমাত্র কাগজে-কলমে থাকলেও দিন দিন খালের অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। খালের অস্তিত্ব রক্ষা ও অবৈধভাবে দখল হওয়া খাল উদ্ধার করলে কৃষকরা কৃষি জমিতে পানি সেচের সুবিধা পাবেন। না হয় এ খালটি কাগজে-কলমে থাকলেও অবস্থান ভিটি জমির মতো হয়ে যাবে। তাদের দাবি, খালগুলো উদ্ধারসহ জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা না হলে কখনোই জলাবদ্ধতা ও বন্যার কবল থেকে উপজেলাবাসী নিস্তার পাবে না।

            এ ব্যাপারে সোনাইমুড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছরিন আখতার ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দ্বীন আল জান্নাত বলেন, উপজেলাবাসীকে জলাবদ্ধতা ও বন্যার কবল থেকে রক্ষায় পানি প্রবাহ সচল রাখতে খালের উপর নির্মিত অবৈধ বাঁধ, স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অচিরেই জবর দখলকারীদের কবল থেকেই খালসমূহ উদ্ধার করা হবে। -মানবজমিন

Share This