বিশ্বাস ও আস্থার নবায়ন মাহে রবিউল আউয়াল


মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক\ রবিউল আউয়াল মানব ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের স্মারক। বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসেই পৃথিবীতে আগমন করেছেন। এ মাসেই তিনি মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেছেন এবং এ মাসেই এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেছেন। তাই এ মাসে যেমন ভক্তহৃদয়ে আনন্দ ও বেদনার যুগল ধারা উৎসারিত হয় তদ্রæপ তা প্রিয়তম নবীর আদর্শ বাস্তবায়নে সর্বত্যাগী হওয়ার পয়গামও ধারণ করে।
নবী আলাইহিস সালাম চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেছেন এবং তেষট্টি বছর বয়সে এই নশ্বর জগত থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। মাত্র তেইশ বছরের কর্মসাধনায় তিনি জীব ও জগতের যে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে তা মানব ইতিহাসের গৌরবময় ও উজ্জ্বলতম অধ্যায়। তিনি ছিলেন মনুষ্যত্ব নির্মাণের ঐশী কর্মপন্থার ধারক রাসূল। তাঁর সেই শিক্ষা ও আদর্শ যথাযথরূপে সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। মহান আল্লাহর অমোঘ ঘোষণা- ‘আমিই এই উপদেশ নাযিল করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব।’
নবী আলাইহিস সালাম বলে গেছেন, তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা তা আকড়ে ধরে রাখবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার ‘সুন্নাহ’। তাঁর এই বাণীর সত্যতা মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও অবনতি উভয় ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হয়েছে।
মাহে রবিউল আউয়াল জগদ্বাসীর কাছে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহর নিকট আত্মশুদ্ধি ও সমাজ সংস্কারের পয়গাম নিয়ে আসে। এ পয়গাম বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ভূখন্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সর্বজনীন। আত্মশুদ্ধি ও আত্মউন্নয়নের জন্য যেমন, তেমনি সমাজদেহ থেকে অন্যায়-অবিচার, শোষণ-লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও অবিশ্বাসের দূষিত কণিকা পরিষ্কার করার জন্যও এ আদর্শের বিকল্প নেই।
আজ বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ও পশুত্বের যুগপৎ উন্নতিতে অশান্তি ও অস্থিরতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসহায় মানুষ শাস্তির পথ খুঁজে ফিরছে। আমাদের এ ক্ষদ্র্র ভূখন্ডেও নানা মহলে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উচ্চারিত হচ্ছে। দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্য সব সেক্টরে দুর্নীতি ও অসাধুতার যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে এসবে অভ্যস্ত ও ভুক্তভোগী জনগণও বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে খুব মনোযোগের সঙ্গে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা দরকার তা হল, যাদের নামে দুনীর্তির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তারা এ সমাজের কোনো পশ্চাৎপদ শ্রেণী নয়; বরং বর্তমান সময়ের প্রাগ্রসরতার সকল মানদন্ডে তার উত্তীর্ণ। তাহলে যারা আত্মশুদ্ধির কথা বলছেন এবং যারা সমাজের ধারা পরিবর্তন করতে চাইছেন তাদেরে একদম নতুন করে ভাবতে হবে। উন্নতি অগ্রগতির যে সংজ্ঞা বস্তবাদী সমাজব্যবস্থার অবিরাম প্রচারণার ফলে আমাদের মন-মানসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার দিকেও একবার নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে হবে।
পাশ্চাত্য-সভ্যতা আমাদের কী দিয়েছে, আর কী হরণ করেছে তা বিচার করে দেখার মনোবলও সঞ্চায় করতে হবে। এই মোহাচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই কেবল সেই আদর্শের মূল্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে যা তার স্বজনদের পক্ষ থেকেই মর্মান্তিক অবহেলার শিকার। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদর্শের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কারের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, আজ তার প্রতি নতুন করে বিশ্বাস স্থাপনের সময় এসেছে।
আমাদের ব্যক্তি-জীবন, সমাজ-জীবন, শিক্ষানীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে যে অঘোষিত ‘অবিশ্বাসে’র ছায়াপাত ঘটেছে তা থেকে আমাদের অতিসত্তর বের হয়ে আসতে হবে। এ কাজ কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। প্রয়োজন সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং সঠিক পথে অবিশ্রাম কর্মসাধনা।
উল্লেখ্য, একথাও বলা দরকার যে, কেবল আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব দিবসপালন দিয়ে এই বিপ্লব সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ের দিবস-সংস্কৃতি যে ফাকিবাজিরই আধুনিক সংস্করণ তা কোনো সচেতন মানুষেরই অজানা থাকার কথা নয়। উপসংহারে বলা যায়, রবিউল আউয়ালের পয়গাম ঈমানী জাগরণের পয়গাম; রবীউল আউয়ালের বারতা কর্মসাধনার বারতা।