শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আলীয়া ও কাওমী মাদরাসার কিছু সমস্যা প্রসঙ্গে

আলীয়া ও কাওমী মাদরাসার কিছু সমস্যা প্রসঙ্গে

:অধ্যক্ষ ইয়াছিন মজুমদার:

২০২৪ সালে সরকারিভাবে মাদরাসার ক্লাস রুটিন প্রণয়ন করে প্রেরণ করা হয়েছে। দৈনিক আট পিরিয়ড ক্লাসের মধ্যে শেষ পিরিয়ডসহ মোটামুটি তিন পিরিয়ড আরবিসহ মাদরাসার বিষয়গুলোর জন্য বাংলা, ইংরেজি, জীবন জীবিকাসহ পাঁচ পিরিয়ড সাধারণ বিষয়ের জন্য রুটিনের  সেট করে দেয়া হয়েছে। সপ্তাহে মোট ৪০টি ক্লাসের মধ্যে মাদরাসার বিষয়গুলোর জন্য ১৬টি ক্লাস, বাকি ২৪টি ক্লাস সাধারণ বিষয়ের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে বিরতি রাখা হয়েছে ১২টা ৪৫ মিনিট থেকে ১টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত, প্রায় মসজিদ যোহরের জামাত ১টা ৩০ মিনিটে সে হিসেবে মসজিদে জামাতে নামাজ পাওয়া সমস্যা হবে। নির্ধারিত কোনো বিষয় রুটিন থেকে যেন বাদ না যায় সে নির্দেশনা দিয়ে রুটিনের দায়িত্ব মাদরাসা কর্তৃপক্ষের হাতে প্রদান করলে উত্তম হতো মনে করি। মাদরাসা শিক্ষা দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষার একটি আদর্শ কেন্দ্র। মাদরাসার শিক্ষকগণ এটাকে শুধু চাকুরী মনে করে শিক্ষা প্রদান ও বেতন গ্রহণ করে দুনিয়ায় বিনিময় গ্রহণের সাথে সাথে দ্বীনি খেদমত হিসেবে পরকালে প্রতিদান পাওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। সেজন্য তাদেরকে অতিরিক্ত সময়, শ্রম ও কৌশল প্রয়োগে সঠিক নৈতিক শিক্ষা ও যোগ্য আলেম হওয়ার পথ প্রসারিত করতে ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমানে দশটার পূর্বে সমাবেশ, জাতীয় সংগীত শেষ করে দশটা থেকে শ্রেণী কার্যক্রম শুরু করে বিকেল চারটা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত ৮ পিরিয়ড শ্রেণী কার্যক্রম চালাতে হয়। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আরও কিছু সময় এগিয়ে ও পিছিয়ে অন্য পিরিয়ডগুলোকে দু’চার মিনিট কমিয়ে সমন্বয় করে রুটিনে ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত একটি বিশেষ ক্লাস যোগ করে নয় পিরিয়ড ক্লাস করা যেতে পারে। অতিরিক্ত পিরিয়ড তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত তাজবীদ, কেরাত, সূরা মাশক। চতুর্থ শ্রেণীতে তিন দিন তাজবীদ ও কেরাত, দুই দিন মিজান। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে দুই দিন কিরাত, ৩ দিন মিজান মুনসায়েব। কোন শ্রেণীতে কোন কোন সুরা মাশক/ মুখস্থ লিখানো হবে তা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। সপ্তম শ্রেণীতে তিনদিন মুনসায়েব, দুইদিন ইংরেজি গ্রামার। মিজান মুনসায়েবের জন্য সহজ কিতাব- রফিকুল মুবতাদি পাঠ্য করা যেতে পারে। অষ্টম শ্রেণীতে তিন দিন ছরফ, দুইদিন নাহু। অষ্টম শ্রেণীর সরকার প্রদত্ত  আরবি দ্বিতীয় পত্র বইটির প্রথম অংশে ছরফের তালিল তাহকীক শিক্ষার বিষয়গুলো রয়েছে, দ্বিতীয় অংশে নাহুর সহজ নিয়ম রয়েছে, তাই অতিরিক্ত বিশেষ ক্লাসেও সে বইটি রাখা যেতে পারে। নবম শ্রেণীতে তিন দিন গ্রামার, দুই দিন ব্যাকরণ। দশম শ্রেণী থেকে আলিম পর্যন্ত নাহু, বিশেষ করে হেদায়েতুন্নাহু সম্পূর্ণ সমাপ্ত করে তারকিব চর্চা, আরবিতে রচনা,চিঠি, দরখাস্ত লিখা ইত্যাদি শেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ক্লাস রুটিনে নাহু, ছরফ, গ্রামার, ব্যাকরণ যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে, যদিও বিশেষ ক্লাসে সেগুলো পুনরায় অর্ন্তভুক্ত হয়। অপরদিকে যিনি আরবি, ইংরেজি পড়াবেন শব্দার্থগুলো আগে মুখস্ত করিয়ে দিলে শিক্ষার্থীদের উপকার হবে। জাতীয় দিবসগুলোতে  আলোচনাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বড় বড় বন্ধগুলোর শুরুর দিকে দুই তিন দিন খোলা রেখে ইংরেজি আরবি ভাষায় বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, ইসলামী সংগীত, বিতর্ক ইত্যাদি শ্রেণী প্রতি বাধ্যতামূলকভাবে কিছুদিন করালে শিক্ষার্থীদের সাহস, উৎসাহ, বলার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে সকল ক্ষেত্রে যোগ্য আলেম তৈরীর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের সাধারণ শিক্ষার উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ যে অবস্থায় পৌছুচ্ছে তাতে আমাদের সন্তানরা শিক্ষিত হলেও মানুষ হতে পারছে কিনা তা চিন্তার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে রাজনৈতিক আনুকুল্যে কিছু ছাত্রনেতা, কিছু সিনিয়র ছাত্র হোস্টেলের জুনিয়র ছাত্রদের কর্মচারীর মত ব্যবহার করে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করে। অশ্লীল ও কষ্টদায়ক র‌্যাগিং এর শিকার হতে হয়। অনেকে মাদক বিক্রির ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়াতে জুনিয়রদের মাদকে অভ্যস্ত করে কাস্টমার বাড়ায়। সেখানে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন, বুয়েটের হোস্টেলে আবরারের মতো মেধাবী ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা, সুন্দরী মুনিয়াদের দামী ফ্লাট ভাড়া নিয়ে বসবাস ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ইত্যাদি হচ্ছে। অথচ বড় বড় মাদরাসাগুলোর হোস্টেলে এ ধরনের কোন ঘটনা নেই। তাই মানুষ মাদরাসা শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছে। নুরানী পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার প্রাইমারি স্কুলের চেয়ে মাদরাসার নূরানীতে শিক্ষার্থী বেশি। বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে রেজিষ্ট্রেশন করণ, ইউনিক আইডি করা, নৈপুণ্য অ্যাপসে ছাত্রদের বিষয়ভিত্তিক নম্বর যোগ্যতা অন্তর্ভুক্ত করা, এর উপর তার চাকরিসহ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে অ্যাপসে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে অ্যাপস এর নিদিষ্ট বিষয়ের বাইরে কোন বিষয়ে পাঠদানের সুযোগ থাকবে না। তখন স্কুল, আলিয়া, কওমী শিক্ষায় নিচের দিকে পাঠ্য বিষয়ের বাইরে কোন বিষয়ে পাঠদানের সুযোগ থাকবে না। তখন স্কুল, আলিয়া কওমী শিক্ষায় নিচের দিকে পাঠ্য বিষয়ে খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না, একমুখী শিক্ষা হবে। আলিয়া মাদরাসায় এখনো ভালো আলেম হওয়ার মত বিষয় সিলেবাসে রয়েছে, যেমন আরবি সাহিত্য (আদব), নাহু, ছরফ, কুদুরী, অচুলে শাশী নুরুল আনোয়ার, শরহে বেকায়া, মিশকাত, ফরায়েজ, আকাইদ, বালাগাত, মানতিক, হেদায়া, তাফসিরে জালালইন, কামিল হাদিস বিভাগে তাফসীরে বায়জাবী, কাশশাফ আংশিকসহ সিহাহসিত্তার সবগুলো কিতাব সম্পূর্ণ সিলেবাস। তাফসীর বিভাগে তাফসীরের কিতাবগুলো- ফিকহ বিভাগ, আদব বিভাগ এভাবে আলাদা বিভাগে আলাদা কিতাবগুলো সিলেবাস রয়েছে। তারপরও অনেকে না জেনে বলে থাকেন আলিয়ায় ভালো আলেম হওয়ার সিলেবাস নেই। মূলত যুগোপযোগী শিক্ষার সমন্বয় প্রয়োজন রয়েছে। সকলে শুধু মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম হলে প্রশাসন চালাবে কারা? শিক্ষকতা ও ইমামতির যোগ্যতার সাথে সাথে প্রশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনার যোগ্যতা অর্জন জরুরী। আলিয়া মাদরাসার সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা হল- প্রথমত সাধারণ বিষয়ের চাপ বর্তমানে কিছুটা বেশি, তা কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত আলীয়ার মেধাবীরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পেয়ে সেদিকে চলে যাচ্ছে, ফলে কম মেধাবী যারা ওইগুলোতে সুযোগ পাচ্ছে না তারাই মাদরাসায় থেকে আলেম হওয়ার চেষ্টা করছে। ভালো মেধাবী না হলে ভালো আলেম কিভাবে হবে? মেধাবীদের কিছু সংখ্যক হলেও যেন ভালো আলেম হতে উৎসাহী হয়, শিক্ষককে সে দিকে উৎসাহিত করতে হবে। পোশাক চালচলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রাখতে চেষ্টা করতে হবে। তৃতীয়ত ৩০% মহিলা কোটা থেকে বেরিয়ে মহিলা মাদরাসায় ১০০% মহিলা শিক্ষিকা পুরুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০% পুরুষ শিক্ষকের ব্যবস্থা এবং সহশিক্ষার প্রভাব কমাতে আরো বেশি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে অবশ্য সহশিক্ষার পরও পরিবেশ সুন্দর রয়েছে। তাদের  শিক্ষকরা ও কোনদিন ছাত্রীদের চেহারা দেখেনি। তারা বোরকা পরে আসে, কখনো চেহারা খোলে না। অপরদিকে শ্রেণীতে ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যখানে কাপড়ের পর্দা দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়, যাতে ছাত্রছাত্রী কেউ কাউকে দেখার সুযোগ পায় না। সেখানে ছাত্রছাত্রী একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে কথাবার্তা বলে না। অনেকে মহিলাদের আলাদা শাখা, পুরুষদের আলাদা শাখা, আলাদা ক্লাসরুম করে ইসলামি পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ, সাধারণ শিক্ষার তিন স্তর, তিনটি ভবন বরাদ্দ পায়, তিনজন প্রধান শিক্ষক থাকে। সে অনুপাতে কর্মচারী জনবল বরাদ্ধ থাকে। কিন্তুু মাদরাসায় তিনটি স্তর, একত্রে সংযুক্ত থাকায় তিনটি সুবিধার ক্ষেত্রে মাত্র একটি সুবিধা পায়, এ বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রাইমারির সকল ছাত্র উপবৃত্তির টাকা পায়, মাদরাসার ইবতেদায়ি ছাত্রদের উপবৃত্তি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক ছাত্র কওমিতে পড়ে বা হিফজ শেষ করে আলিয়ায় ভর্তি হয়। কোন শ্রেণীতে বয়স কত তা নির্ধারিত থাকায় হিফজ ও কওমী থেকে আসা ছাত্রটির বয়স কিছু বেশি হওয়ায় সে ভর্তি হতে পারে না। অনেক সময় ছাত্রটি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। আমার মতে চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্ধারিত থাকলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের সীমারেখা তুলে দেয়া দরকার। আমাদের জাতীয় সংসদে আলেমদের প্রতিনিধি প্রায় সময় ছিল, বর্তমানেও ফুলতলীর সাহেবজাদা (পীর সাহেব) সহ আলেম ও ইসলামী মনা ব্যক্তি সংসদে রয়েছে। তারা এবং মাদরাসা শিক্ষক সংগঠন নেতৃবৃন্দ সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখবে আশা করি।

লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, লাকসাম, কুমিল্লা। মোবাইল নং ০১৯৭১৮৬৪৫৮৯

Share This

COMMENTS