রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার ভোর রাত পর্যন্ত বয়ে যাওয়া ঘুর্নিঝড় ‘মিধিলা’র ভয়াবহ তান্ডবে কুমিল্লা জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঘরের উপর গাছ পড়ে ২ জন নিহত হয়েছে। বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে যাওয়ায় কোনো এলাকা ৪৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো।

            লাকসাম উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বসতঘর, গাছপালা উপড়ে যায়। উপজেলার লাকসাম পূর্ব ইউনিয়নে ঘুর্নিঝড় মিধিলির আঘাতে তাজুল ইসলামের পোল্ট্রি খামার, মানিক মিয়ার পোল্ট্রি খামারে প্রায় ২০ লাখ টাকার মোরগ মরে যায়। এছাড়া, শতাধিক ঘর ভেঙ্গে যায়। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে ৪দিন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলহাজ আলী আহম্মদ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তাদের সম্ভাব্য সাহার্য্যরে আশ্বাস দেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ মাজহারুল ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।

            জেলার  মনোহরগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র আঘাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছপালা ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে যাওয়ায় এ উপজেলায় ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। পাশাপাশি টানা বৃষ্টিতে ইরি ধানের বীজতলা ডুবে যাওয়ায় এখানকার কৃষকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার পোমগাঁও, মানরা, কাশই, বাংলাইশ, ডুমুরিয়া, মনিপুর, বান্দুয়াইন, শমশেরপুর, বাদুয়াপাড়া এলাকায় ১৮টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে লাইন বিপর্যস্ত হয়। বিভিন্ন এলাকায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

            এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলা’র প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে ফসলি মাঠে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ইরি ধানের জন্য তৈরি করা বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে শত শত কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

            উপজেলার লৎসর গ্রামের কৃষক বশির উল্ল্যা, হাটিরপাড় গ্রামের কৃষক এনায়েত উল্লা, খিলা গ্রামের কৃষক ইব্রাহীমসহ অন্তত ১০ কৃষক জানান, ইরিচারা রোপনের জন্য তৈরি বীজতলা টানা বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে যায়।

            কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৪-এর মনোহরগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানাজার (ডিজিএম) নীল মাধব বনিক বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ১৮টি বৈদ্যুতিক পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পোমগাঁও গ্রামেই রয়েছে ৮টি। এসবের পিলারের মধ্যে বেশির ভাগ পিলার ভেঙে যায় এবং কিছু পড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদ্যুৎ কর্মীরা বেশ কয়েকটি পিলারের সংযোগ দিয়েছেন। বাকি ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামতের কাজ চলছে।’

          

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মিধিলার প্রভাবে এই এলাকার বেশ কিছু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বীজতলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। অতি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষকের ডুবে যাওয়া বীজতলা রক্ষায় পানি নিষ্কাশনসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’

            ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার পেরিয়া, বাঙ্গড্ডা, মক্রবপুর, রায়কোট উত্তর, দক্ষিণ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাসহ উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ঝড়ের তান্ডবে বিদ্যুৎ লাইন লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সড়কে গাছ উপড়ে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায় এবং বাড়ি ঘরের উপর গাছ পড়ে অনেকের বসত ঘর তছনছ হয়ে যায়। রোপা আমন ধানের ফসল ও আগাম শীত কালিন শাক-সবজির জমিনগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, ঘরের উপর গাছ ভেঙ্গে পড়ে এয়াছিন মিয়া (৬০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু ও অসংখ্য মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বৃদ্ধ এয়াছিন মিয়া পাশ্ববর্তী  লালমাই উপজেলার ধানওড়া ও নাঙ্গলকোট উপজেলার উত্তর শাকতলী গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করে আসছে। তবে তিনি ও তার পরিবারের লোকজন পাশ্ববর্তী লালমাই উপজেলার ভোটার। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গাছ ভেঙ্গে ঘরের চালার উপর পড়ে গাছ ও ঘরের চাপে ঘটনাস্থলে ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। বৃদ্ধ এয়াছিনের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

            ঘূর্ণিঝড় মিধিলি এয়াছিনের ছেলেমেয়েদেরকে শুধু এতিম করেনি, চুরমার করে দিয়ে গেছে তাদের মাথা গোঁজার একমাত্র বসতঘরটিকেও। সরকারের পক্ষ থেকে ভূক্তভোগী পরিবারকে সহায়তার দাবি জানান এলাকাবাসি। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন লালমাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌমিতা দাস ও বেলঘর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী গাজী, নাঙ্গলকোটের পেরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ হামিদ।

            স্থানীয় সূত্র জানায়, ধানওড়া দক্ষিণ পাড়ায় শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ওই গ্রামের মৃত আলী আহম্মদের ছেলে এয়াছিনের টিনের ঘরের উপর একটি আকাশমনি গাছ ও একটি কাঁঠাল গাছ আছড়ে পড়ে। এসময় গাছের আঘাতে ঘর ভেঙ্গে ঘুমিয়ে থাকা বৃদ্ধ এয়াছিনকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। পরে স্থানীয়রা গাছ সরিয়ে ওই বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে। মৃত এয়াছিনের ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে রয়েছে।

            এব্যাপারে এয়াছিনের ভাই ইব্রাহীম খলিল বলেন, গাছ ও ঘরের চাপে আমার ভাই খাটের মধ্যেই মারা গেছে। পরে আমরা লোকজন নিয়ে তাকে মৃত বের করে নিয়ে আসি।

            নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী অফিসার রায়হান মেহেবুব বলেন, আমি বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করার জন্য বলেছি। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর তাদেরকে সহযোগীতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

            ঘুর্ণিঝড় মিধিলি’র তান্ডবে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর আমন মৌসুমে উপজেলার ১৪ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিনে বিভিন্ন জাতের ধান গাছ রোপন করা হয়েছে।

            মিধিলা’য় সৃষ্ট ঝড় এবং বৃষ্টিপাতের ফলে আবাদকৃত আমন ধানের মধ্যে অন্তত ৬০-৭০% ধান গাছ পানির উপরে ভেসে গেছে। অনেকাংশে ধান গাছ হেলে পড়ে পানিতে ডুবে গেছে। ঝড়ো বৃষ্টি ও প্রবল বাতাসে শাক-সবজিরও ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।

            ক্ষতিগ্রস্ত কৃষাণী ও ইউপি সদস্য নাছরিন বেগম জানান, ঘুর্ণিঝড় এবং ভারী বৃষ্টিতে অন্তত ১’শ ৫০ শতক জমিনে রোপনকৃত আমন ধান নষ্ট হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতকের ব্রি-৪৯ জাতের ধান গাছ পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

            পৌরসদরের দক্ষিণ ফালগুনকরার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুর রউপ জানান, ২-১ দিন পরেই আমার ২ একর ৪০ শতক জমিনের ব্রি-৮৭ জাতের ধান কেটে ঘরে তোলার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু হঠ্যাৎ করেই মিধিলা’র তান্ডবে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আমার অধিকাংশ ধান গাছ পানির মধ্যে ভেসে রয়েছে। দ্রæত পানি না নামলে ধান একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।

    উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোবায়ের হোসেন জানান, ঘুর্ণিঝড় মিধিলা’য় সৃষ্ট তান্ডবে চৌদ্দগ্রামে আমন ফসল এবং উৎপাদিত শাক-সবজি ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন বø­ক থেকে পুরোপুরি তথ্য না আসায় এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায়নি।

            কুমিল্লার লালমাইয়ে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র প্রভাবে ঘরের ওপর গাছ পড়ে ২জন নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার রাত ৩টার দিকে উপজেলার বেলঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের ধানোরা গ্রামের এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, ধানোরা গ্রামের মৃত আলী আহমদের ছেলে মো. ইয়াসিন (৪৫) এবং তার প্রতিবেশী রমিজ উদ্দিনের স্ত্রী মোসা. আনোয়ারা বেগম (৭০)।

            স্থানীয় বেলঘর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লেয়াকত হোসেন গাজী বলেন, গাছ পড়ে ইউনিয়নের ধানোরা গ্রামের একজন নারী ও একজন পুরুষের ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছেন। নিহত পরিবারে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে।

            লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌমিতা দাশ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুক্রবার রাতে তাদের ঘরের ওপর গাছ পড়লে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁরা দু’জন মারা যান। ওই বিদ্যুৎহীন এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘিœত হওয়ায় খবরটি শনিবার দুপুরের জানা গেছে। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়।

Share This