শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জমি রেজিস্ট্রেশন ফী তিন গুণ বাড়িয়েও রাজস্ব আদায়ে ধস:  জমি বেচা-কেনা কমে যাওয়ায় দলিল লেখকদের মাথায় হাত

জমি রেজিস্ট্রেশন ফী তিন গুণ বাড়িয়েও রাজস্ব আদায়ে ধস: জমি বেচা-কেনা কমে যাওয়ায় দলিল লেখকদের মাথায় হাত

Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ দেশে সাফকবলা দলিল রেজিষ্ট্রীর সংখ্যা অন্তত: ৮০% ভাগ কমে গেছে। আগে দিনে ১০টা সাফকবলা দলিল হলে এখন হয়ে থাকে ২টা। এতে করে একদিকে জমি রেজিস্ট্রেশন ফী তিন গুণ বাড়িয়েও রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। আরেকদিকে, জমি কেনা-বেচায় ভাটা পড়ার কারণে দলিল লেখকদের মাথায় হাত পড়েছে।

            ঢাকার ধামরাইয়ের কালিদাসপট্টি গ্রামের হাজি শরীয়ত উল্লাহর ছেলে মনির হোসেন ২ মাস আগে উলাইল মৌজায় জমি কেনার জন্য মালিকের সঙ্গে বায়নানামা করেন। শতাংশপ্রতি ২২ হাজার টাকা দরে ওই জমির দর দাঁড়ায় ৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। কালামপুরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে জানতে পারেন, ওই জমির সাফকবলা দলিল করতে সরকারি মাশুলই (ফি) দিতে হবে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮২ টাকা। অন্যান্য খরচ তো আছেই। এর পর তাঁর জমি কেনার ইচ্ছা উবে যায়। মনির হোসেন বলেন, ‘এখন বায়নার দুই লাখ টাকাও ফেরত চেয়ে পাচ্ছি না। জমিও রেজিস্ট্রি করে নিতে পারছি না। ওদিকে রেজিস্ট্রি করতে চাপ দিচ্ছেন জমির মালিক।’

            কালামপুর দলিল লেখক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ফজলুল হক জানান, এ অর্থবছরে উলাইল মৌজায় প্রতি শতাংশ জমির গড় দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সে হিসাবে বিভিন্ন ফিসহ জমির চেয়ে রেজিস্ট্রি খরচ এখন বেশি হয়ে যাচ্ছে। অথচ কয়েক মাস আগে ওই পরিমাণ জমি ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকায় রেজিস্ট্রি করা যেত।

            এমন চিত্র শুধু ধামরাইয়ের নয়; ঢাকা ও আশপাশের সব জেলা-উপজেলায়। এলাকাভিত্তিক ন্যূনতম দর নির্ধারণ ও উৎসে কর, স্ট্যাম্প শুল্কসহ বিভিন্ন ফি বাড়িয়ে তিন গুণ করার কারণে দলিলের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। অনেকে জমি কেনাবেচা করলেও অতিরিক্ত দলিল খরচের কারণে সাফকবলা দলিল করছেন না। হেবা, ঘোষণা, পাওয়ার, ব্যাংক মর্টগেজ, এওয়াজ ও আমমোক্তার দলিল করছেন। এতে সরকারের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় রাজস্ব আদায়ের এ খাতে আয়ও অনেক কমেছে। দলিল খরচ বাড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, অথচ সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

            বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির মহাসচিব জোবায়ের আহমেদ  বলেন, খরচ বাড়ার কারণে সাফকবলা দলিল কমেছে ৮০ শতাংশ। আগে দিনে ১০টা সাফকবলা দলিল হলে এখন হয় দুইটা। অন্যগুলো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, হেবা দলিল বা অন্যভাবে হয়। আবার এলাকাভিত্তিক জমির সর্বনিম্ন দাম ও সর্বনিম্ন রেজিস্ট্রি ফি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যেটাতে বেশি খরচ পড়বে, সেই টাকায় দলিল করতে হবে। ফলে কম দামে জমি কিনলেও সরকার নির্ধারিত দরে দলিল করতে হচ্ছে। এ জন্য কখনও কখনও জমির চেয়ে রেজিস্ট্রি খরচ বেশি পড়ে যাচ্ছে।

            এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খরচ বাড়ার কারণে দলিলের সংখ্যা কমলেও রাজস্ব খুব একটা কমেনি। একটি দলিল থেকেই তিনটি দলিলের সমান রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে। যারা সাফকবলা দলিল না করে অন্য দলিল করছেন, আজ হোক-কাল হোক, একদিন তাদের সাফকবলা দলিল করতেই হবে। তখন সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে তারা পারবে না।’

            সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকাভিত্তিক ন্যূনতম দর নির্ধারণ ও ফি বাড়ার কারণে দলিলের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার দলিল লেখকরা পড়েছেন বিপাকে। বিভিন্ন ধরনের কর হ্রাস ও জমির দাম নির্ধারণ না করার দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করে তারা স্মারকলিপিও দেন। আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সাভার ও ধামরাই এলাকার দলিল লেখকরা কিছুদিন ধর্মঘটও পালন করেন। আইন সচিব গোলাম সারওয়ার বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত এখন আইন মন্ত্রণালয়ের নেই।

            সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে সংক্রান্তে নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় খুব একটা না কমলেও সার্বিকভাবে ঢাকা জেলায় দলিলের সংখ্যা ও রাজস্ব কমেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা জেলায় দলিল হয় ২৪ হাজার ৩৫২টি। এ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ২৭ কোটি ২২ লাখ ৭৬ হাজার ৮১৯ টাকা। গত সেপ্টেম্বরে দলিল হয়েছে ২২ হাজার ৫৭৬টি। রাজস্ব পাওয়া গেছে ২২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৯ হাজার ২২০ টাকা। দলিলের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৭৭৬টি। রাজস্ব কমেছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৭ হাজার ৫৯৯ টাকা। তবে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় হয়েছে। ঢাকা জেলা থেকেই মিলেছে ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ২৫৬ টাকা। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১লা জুলাই থেকে দলিলমূল্য বাড়ার সরকারি সিদ্ধান্তের খবর আগেভাগেই জানাজানি হয়ে যায়। অনেকে অর্থবছর শুরুর আগেই দলিল করে ফেলেন। এ জন্য গত জুলাইয়ে দলিলের সংখ্যা ও রাজস্ব আদায়ে ধস নামে। রাজস্ব আদায় ১০ কোটিতে নেমে আসে।

            দলিল খরচ বাড়ার চিত্র হলো- বর্তমান নিয়মে দলিলে লিখিত মূল্যের ১ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন ফি, ১ দশমিক ৫০ শতাংশ স্ট্যাম্প শুল্ক, এলাকাভেদে স্থানীয় সরকার কর ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) অন্তর্ভুক্ত এলাকার জন্য ৫ শতাংশ, অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার জন্য ৪ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে ৪ শতাংশ ভ্যাট। ফলে পাঁচ লাখ টাকার জমি কিনতে হলে সর্বনিম্ন ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অথচ আগে খরচ হতো মাত্র ১৩ হাজার ৫০০ টাকা।

            সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে জমির দাম কম দেখানোসহ নানা অনিয়ম রোধে গত বছরের নভেম্বরে বাজারমূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। নতুন নিয়মে উল্লিখিত ফি ছাড়াও জমি কেনাবেচায় ব্যবসায়ীদের ওপর ৮ শতাংশ গেইন ট্যাক্স (লাভের দামের ওপর কর) চালু করা হয়। ফলে জমির রেজিস্ট্রেশন ফির খরচ আরও বেশি পড়ে। বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য লতিফ রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আক্তার বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে জমি রেজিস্ট্রির খরচ সম্পত্তির দাম অনুযায়ী বেশি হয়ে গেছে। আমাদের প্রস্তাব ছিল জমির দাম বাড়ানো হোক; স্ট্যাম্প ফি কমানো হোক। একদিকে যখন একটু কমায়, তখন আরেক দিকে বাড়িয়ে দেয়। এখন জমির দামের ৪০ শতাংশ অর্থ সরকারকেই দিতে হচ্ছে।

            চুক্তিমূল্য বা ন্যূনতম করের যেটা বেশি, সেই দরে রেজিস্ট্রি বিষয়ে- চলতি বছর এলাকাভিত্তিক করও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বনানী এলাকায় এক কাঠা জমির ন্যূনতম নিবন্ধন কর দিতে হবে ২০ লাখ টাকা। তবে এর চেয়ে চুক্তিমূল্য অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন ফি বেশি হলে সেই দরে জমির সাফকবলা দলিল করতে হবে। এভাবে গুলশানে প্রতি কাঠা ২০ লাখ, বসুন্ধরায় ১০ লাখ, বারিধারায় ১০ লাখ, কাকরাইলে ১২ লাখ, কারওয়ান বাজারে ১২ লাখ, ধানমন্ডিতে ১০ লাখ, মতিঝিলে ২০ লাখ, গেন্ডারিয়ায় ৮ লাখ, শাহবাগ এলাকায় ১২ লাখ টাকার মতো ন্যূনতম দলিল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে জমির চুক্তিমূল্য হিসেবে কর এর চেয়ে বেশি হলে ক্রেতাকে ওই বর্ধিত ফি দিয়ে দলিল সম্পন্ন করতে হবে। এর সঙ্গে মুহুরির খরচসহ অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।

            মাঠের চিত্র নাজুক অবস্থাটা হলো- বাণিজ্যিকভাবে সুবিধাজনক হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি জমি বিক্রি হয়েছে। সেই গাজীপুরেই গেল ছয় মাস আগের চেয়ে জমি কেনাবেচা অর্ধেকে নেমে এসেছে। শ্রীপুর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আছমত আলী বলেন, উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আগে প্রতিদিন শতাধিক দলিল সম্পাদন হতো। এখন সেটা অর্ধেকে নেমেছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমির মূল্য ১০ লাখ টাকার বেশি হলে টিন সনদ লাগছে। জমির রেজিস্ট্রি ফি বাড়ানো, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরিতে নানা জায়গার অনুমতির ভোগান্তি এর কারণ।

            গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, কৃষি বা ফসলি জমি অকৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের পর অনুমতি দেয়া হয়। এ জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে। শ্রীপুরের সাব-রেজিস্ট্রার ওসমান গণি মন্ডল জানান, আগে বিক্রীত মূল্যের সাড়ে ১১ পার্সেন্ট ফি জমা দিতে হতো। সেটা স্থানভেদে কিছুটা কমানো হয়েছে।

            এছাড়া, মুন্সীগঞ্জেও জমির দলিল কমেছে। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে আগে প্রতিদিন গড়ে ১০০টি দলিল সম্পাদন হলেও বর্তমানে ২০-২৫টি হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও জমি কেনাবেচা কমেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় দলিল লেখকরা। মুন্সীগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রার এ কে এম ফয়েজউল্লাহ বলেন, রেজিস্ট্রি খরচ বাড়ার কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

            ময়মনসিংহের ভালুকা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দেয়া হিসাবে দেখা গেছে, গত ১লা জানুয়ারি থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত ভালুকায় প্রতি মাসে ১ হাজার ৭০০ জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে। গত জুলাই ও আগস্টে সাব-রেজিস্ট্রার অসুস্থ থাকায় কোনো দলিল হয়নি। গত সেপ্টেম্বরে ১৮ কার্যদিবসে দলিল হয়েছে ১ হাজার ১৪০টি। অক্টোবরে ২২ কার্যদিবসে দলিল হয়েছে ১ হাজার ৭৩৮টি। প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২২টি দলিল হয়েছে। তবে সাব-রেজিস্ট্রার আনোয়ারুল হাসান জানান, কর বাড়ার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নামজারি জমা-খারিজ বাধ্যতামূলক হওয়ায়।

সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আহম্মেদ সুমন নামের এক ক্রেতা জানান, উত্তর কাউন্দিয়া মৌজায় ২১ লাখ টাকা দিয়ে কেনা সাড়ে ১২ শতাংশ জমির রেজিস্ট্রি খরচই হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। কাঠাপ্রতি ৫০ হাজার টাকা উৎসে কর জুড়ে দিয়ে দলিল কার্যক্রমকে জটিলতায় ফেলে দেয়া হয়েছে।

            কেরানীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতেও আগের মতো এখন আর ভিড় নেই। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মোহরার আকরাম হোসেন বলেন, গত অর্থবছরের ৩০ শতাংশ দলিল এবার হবে কিনা সন্দেহ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও প্রতিদিন একশ-দেড়শ দলিল রেজিষ্ট্রী হতো। এখন সে সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। সৌজন্যে: সমকাল

Share This

COMMENTS