শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে

পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে

            এমরান কবির\ পলিথিন পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ হলো প্ল­াস্টিক। হান্স ফন পেখমান নামের এক জার্মান বিজ্ঞানী ১৮৯৮ সালে গবেষণাকালে দুর্ঘটনাক্রমে এটি আবিষ্কার করেন। এরপর নানা গবেষণা করে ১৯৪৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে এটি বাজারজাত করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়।

            সেই থেকে চলছে। ২০১৭ সালের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০ কোটি টন পলিথিলিন রেজিন উৎপাদিত হয় প্রতিবছর। প্ল­াস্টিকের পুনর্ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও পলিথিনের মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ ১০০ বছরেও পচে না বা মাটির সঙ্গে মেশে না। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে।

            ব্যবহৃত পলিথিন আগুনে পুড়িয়েও ধ্বংস করা যায় না। কারণ পলিথিন পোড়ালে কয়েক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বাতাসে মিশে যায়, যা থেকে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগ হয়।

            পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করতে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে দুই গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং এক হাজার ৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

দেখা যাচ্ছে, পলিথিন গ্রিনহাউস ইফেক্টেরও বড়  কারণ।

            ঢাকা ওয়াসা জানাচ্ছে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূগর্ভস্থ স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্যেমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার পেছনেও রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। পরিবেশে মেশার জন্য প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ খাবারে মিলছে মাইক্রোপ্ল­াস্টিকের উপস্থিতি। খাবারের মাধ্যমে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি।

            অতি ক্ষতিকর বলেই ২০০২ সালের ১লা মার্চ বাংলাদেশ সরকার আইন করে নির্দিষ্ট পুরুত্বের বাইরে সব ধরনের পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকার জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। বাজারজাত করলে রয়েছে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। রাখা হয়েছে নানা রকম শাস্তির বিধান। কেনিয়া সরকার কারো হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি করারোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। সমস্যা হলো, এত সব আইন করেও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কারণ উপযুক্ত ও কার্যকর বিকল্প না থাকা।

            এখানেই আমরা বাজিমাত করতে পারতাম। কারণ আমাদের রয়েছে উপযুক্ত ও কার্যকর বিকল্পের সুযোগ। পাট উৎপাদনে সারা পৃথিবীর মধ্যে আমরা দ্বিতীয়। সারা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৩৩ শতাংশ পাট বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। শুধু তা-ই নয়, আমাদের পাট গুণে ও মানে সারা পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যা আক্ষরিক অর্থেই সোনালি আঁশ। আমরাই একমাত্র দেশ, যা পলিথিনের বিকল্প তৈরি করে পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলাম। এখন সময় এসেছে পলিথিন নিষিদ্ধের আইনের যথাযথ ব্যবহার এবং বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া। গেলে আমরা সহজেই আমাদের চাহিদা মিটিয়েও পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ চাহিদা মেটাতে পারবো শুধু আমাদের দেশে উৎপাদিত পাট ব্যবহারের মাধ্যমে। এতে পলিথিন উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল রেজিন আমদানির জন্য ডলার গুনতে হবে না। উল্টো রপ্তানি করে ডলার আনতে পারব। শুধু তা-ই নয়, এতে চাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।

            পরিবেশ সুরক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমরা চতুর্থ স্থান অর্জন করেছি। না, খুশির খবর নয় এটা। আমরা অর্জন করেছি শুরুর দিক থেকে নয়, উল্টো দিক থেকে। অর্থাৎ খারাপের দিক থেকে চতুর্থ। এ বছর প্রকাশিত বিশ্ব পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। এর আগে ২০২০ সালের তালিকায় ১৬২তম ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি (ইপিআই) থেকে প্রতি ২ বছর পর পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তার মানে, ২ বছরে পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা ১৫ ধাপ পিছিয়ে পড়েছি।

            পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করলে পরিবেশদূষণ রোধ হবে। বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল ব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারা সূচনা হবে।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, ব্যাংকার

Share This

COMMENTS