শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

লাইলাতুল মি’রাজ আলোচনা ও শিক্ষা

 :অধ্যাপক মু. সহিদুল ইসলাম:

প্রেক্ষাপট: শিয়াবে আবুতালিব এ বয়কট তথা বন্দি জীবন থেকে বের হওয়ার ৬ মাস পর রাসুল (সাঃ) এর আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের ৩ দিন অথবা ২ মাস পর খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। সময়টি ছিল নবুয়তের দশম বছর রমযান মাস। রমযান তখন ফরয হয়নি। চাচা আবু তালেব এবং জীবন সঙ্গিনী খাদিজা (রাঃ) এর ইন্তেকাল রাসুল (সাঃ) এর জীবনকে কঠিন পরিস্থিতি পোহাতে হয়। এ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী সময়কে ‘আইয়ামে হুযন’ দুঃখের বছর বলা হয়।

            দ্বীন প্রচারে স্বস্তির নেশায় রাসুল (সাঃ) ১২০ কি.মি. দূরে তায়েফ গেলেন মাতৃক‚লের আত্মীয়দের আল্লহর পথে দাওয়াতের মিশন নিয়ে। কিন্তু দাওয়াত প্রত্যাখান করলো আবদে ইলাইলা, মাসউদ এবং হাবিবের মতো তায়েফের রাগব-বোয়ালেরা। ১০ দিন থাকার পর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সাথী যায়েদ বিন হারেসাকে নিয়ে ফিরে এলেন মাতৃভূমি মাক্কার জমিনে।

            নবুয়তের ১০ বছর ২৭ রযব সোমবার রাতে (আল্লামা মনসুরপুরী (রাঃ) এর মতে) আল্লাহ-তায়ালা তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে গেলেন মাসজিদে আকসা হয়ে ৭ম আসমান ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত। দেখালেন জান্নাত-জাহান্নামসহ বড় বড় নিদর্শন। “পুত-পবিত্র সেই সত্ত¡া! যিনি নিয়ে গেলেন একরাতে তাঁর বান্দাকে মাসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন। বড় বড় নিদর্শনসমূহ দেখিয়েছেন। আসলে তিনি (আল্লাহ তায়ালা) সবকিছু শোনেন ও দেখেন।” বনি ইসরাইল-১। বনি ইসরাইলের ১ম আয়াত এবং ৫৩নং সুরা আল-নজম এর ১-১৭ আয়াতে (ইসরা) রাত্রিভ্রমন তথা মিরাজের কাহিনী বিস্তারিত আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন। আল্লামা যারকানি (রঃ) ৪৫ জন সাহাবী এবং আল্লামা ইবনে কাসির (রঃ) ২৫ জন মর্যাদাবান সাহাবী থেকে মিরাজের হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা কুরতুবী (রঃ) মিরাজের হাদিস সমূহকে ‘মুতা-ওয়াতের’ হাদিস বলেছেন অর্থাৎ এত অধিক সাহাবীর  পক্ষে কোন মিথ্যা ঘটনায় ঐকমত্য হওয়া সম্ভব নয়। তাই বলা যায় মি’রাজকে অস্বীকারকারী ইমানদার হতে পারে না।

মিরাজ কবে ও কখন, কীভাবে  সংঘটিত হয়েছে?

            সাহাবীগণ মি’রাজ কখন হয়েছে এ প্রশ্ন করেননি। রাসুল (রাঃ)ও দিন-তারিখ-সন বলে যাননি, কিংবা মক্কার কাফেররাও দিন সন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। রাসুল (সাঃ) কিংবা সাহাবীদের নিকট মি’রাজের বিশ্বাস, শিক্ষা ও আমলই ছিলো বিবেচ্য বিষয় তাই তাঁরা কখনো প্রশ্ন তুলেননি। রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের ৫০০/৬০০ বছর পরই এ তারিখ সন বার নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ গবেষণা শুরু করেছেন। যেমন-

১. ইমাম নাবাবী ও ইমাম কুরতবী (রাঃ) এর মতে নবুয়তের ৫ বছর পর মিরাজ সংঘটিত হয়েছে।

২. নবুয়তের ১৩তম বছর মুহাররম মাসে মিরাজ হয়েছে-আলামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রা) বিশেষণের ভিত্তিতে মতামত দিয়েছেন।

৩. হিজরতের ১ বছর পূর্বে মি’রাজ হয়েছে- ইমাম ইবনে স’াদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন।

৪. হিজরতের ৮ মাস পূর্বে মিরাজ হয়েছিলো-আল্লামা ইবনুল যাওযী (রঃ) মতামত ব্যক্ত করেছেন।

৫. হিজরতের ১৮ মাস পূর্বে বর্ণনা করেছেন-আল্লামা ইবনুল কুতাইবা (রঃ)

৬. আল্লামা মনসুরপুরী (রঃ) এর মতানুসারে রাসুল (সাঃ) এর মিরাজ তথা ইসরা হয়েছিলো নবুয়তের ১০ বছর ২৭ রযব, সোমবার রাত ইশার পর থেকে ফযর পর্যন্ত সময়ে- এই মতটিই আমাদের বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। যদিও এটাই সঠিক-একথাটি সঠিক নয়।

কখন মি’রাজ হয়েছে?

            আল কুরআনের শব্দ ‘আসরা’- এর অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমন, দিনে নয়! আল্লাহ তায়ালা তার নেক বান্দাদের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন রাত্রিবেলা, ফলে শরিয়তে ‘তাহাজ্জুদ সালাতের’ গুরুত্ব  অপরিসীম। ইমাম তাবারানী হাদিস বর্ণনা করেছেন হযরত আবু বকর (রাঃ)  জিজ্ঞেস করেছিলো-‘হে রাসুল (সাঃ)! “গত রাতে আপনি কোথায় ছিলেন- আমি সকল জায়গায় খোঁজ নিয়ে আপনাকে পাই নাই”-এ হাদিসে রাতের কোন অংশ বুঝায় নাই বরং সারা রাত বুঝিয়েছেন। কুরআনে ‘লাইলান’ শব্দটি ‘নাকারা’ (অনির্দিষ্ট) সুতরাং গবেষক এবং কুরআনের শব্দ বিশ্লেষণে প্রমাণ হয় মিরাজ ইশা থেকে ফযর পর্যন্ত সময়ব্যাপী সংঘটিত হয়েছিলো, তাই ওযুর পানি গড়িয়ে ছিলো, বিছানা গরম ছিলো কিংবা রাসুল (সাঃ) এসে দেখেন দরজা তখনো নড়চে কথাগুলো সঠিক নয়।

            মিরাজ স্বপ্ন যোগে না সশরীরে?

আল্লাহ-তায়ালা কুরআনে দু’টি শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রথমত: ‘সুবহানা’ শরিয়তের অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে আল্লাহ-তায়ালা সুবহানা শব্দটি ব্যবহার করেননি যেমন-

১. হযরত ইউনুস (আঃ) ৪০ দিন মাছের পেটে ২. ইবরাহিম আঃ ৪০ দিন অগ্নিকুন্ডে ৩. মুসা (আঃ) ৪০ দিন তুরপাহাড়ে ৪. ঈসা আঃ বাবা ছাড়া মায়ের কোলে ৫. ইউসুফ আঃ বিনা দোষে পানির ক‚পে কোথাও ‘সুবাহানা’ দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন নাই। মি’রাজ অতি আশ্চার্যান্বিত ঘটনা যা আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সঃ) কে সশরীরে বিশেষভাবে সংঘটিত করেছেন। সে জন্যই ‘সুবাহানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

দ্বিতীয়-‘আবাদিহী’- আমার বান্দা বা দাসকে- দাস, গোলাম, বান্দা হওয়ার জন্য তার বাহ্যিক অবয়ব অর্থাৎ দেহ ও আত্মা উভয় প্রয়োজন। শুধু আত্মাকে দাস বা গোলাম বলা হয় না। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা ‘আসরা’ শব্দ দিয়ে বুঝিয়েছেন রাসুল (সাঃ) নিজে ভ্রমন করেননি আমি আল্লাহই ভ্রমণ করেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বন্ধুকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ‘স্পেশাল গেস্ট’ করে ‘বড় বড় নির্দেশন’ দেখার ব্যবস্থা করেছেন এটা তাঁর পক্ষেই ‘সম্ভব’। সুতরাং এখানে বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম স্থগিত রেখে সশরীরেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুল (সাঃ) কে দৈহিকভাবে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত মিরাজের রাতে ভ্রমন করিয়েছেন।

লেখকঃ সভাপতি, কলেজ শিক্ষক পরিষদ, কুমিল্লা মহানগরী, ০১৭১১-৯৫৩৮১৬১

Share This

COMMENTS