শত শত কর্মকর্তা ছুটি ছাড়াই অনুপস্থিত থাকায় শুধু মামলা গ্রহণের মধ্যেই থেমে আছে পুলিশের পরিষেবা
স্টাফ রিপোর্টার॥ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উত্তেজিত জনতা পুলিশের স্থাপনায় হামলা, ভাংচুরসহ বিভিন্ন থানায় অগ্নিসংযোগ করে। থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের মতো ঘটনাও ঘটে। এ কারণে সরকার পতনের পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মনোবল ফিরে পায়নি পুলিশ।
হামলা ও ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো সংস্কার না হওয়ায় এখনো গতি ফেরেনি পুলিশের কাজে। এছাড়া কর্মকর্তাসহ পুলিশের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। যে কারনে অনেকেই রয়েছেন পলাতক। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনো রয়েছে প্রত্যাহার, বদলি, মামলা এমনকি গ্রেফতারের ভয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে পুলিশের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার। কিন্ত হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখনো ছুটি ছাড়াই অনুপস্থিত রয়েছেন ৭শ’ থেকে ৮শ’ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে কিছু ক্যাডার কর্মকর্তাও রয়েছেন। আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা না থাকায় আ’লীগ শাসনামলে পুলিশ হয়ে উঠেছিলো নিপীড়নের প্রতীক। যে কারণে হাসিনার পলায়নের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৫০টির বেশি থানায় হামলা হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। শীর্ষ স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে পুলিশ সদস্যরা অবগত। এখনো জনরোষের ভয় কাটেনি। গত ৫ই আগস্টের পরে অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে, লুট হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি। এর মধ্যে ইতিমধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি বন্দুক ও দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। বাকিগুলো এখনো পাওয়া যায়নি। দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে তাই দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যরা জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছেন।
এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পুলিশ সুপারদের আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অতীতের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া জনগণের আস্থা অর্জন করা পুলিশেরই দায়িত্ব।
বর্তমানে পুলিশের পরিষেবা মূলত অভিযোগ গ্রহণ এবং মামলা নিবন্ধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ হটলাইন গত ৯ই আগস্ট সীমিত আকারে এবং ১২ই আগস্ট পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে।
কিন্তু থানাগুলোতে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য ও লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় ওই নম্বরে ফোন করেও সেবা মিলছেনা। জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯-এ পুলিশের সহায়তা চেয়ে যত ফোন কল করা হয়েছে, তার সবগুলোই সশস্ত্র বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছিল।
একাধিক থানার দায়িত্বশীলরা বলেছেন, মামলার নথি, পরোয়ানা, গাড়ি সব কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। অস্ত্র ও গুলি লুট হয়েছে। আমরা সীমিত আকারে টহল শুরু করেছি, তবে অনেক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। পুলিশ প্রধান মইনুল ইসলাম নিজেও সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা কখনো পুলিশিং বন্ধ করিনি। কোথাও কোথাও থানা ভাঙচুর করা হয়েছে, প্রায় ৩০০ যানবাহন ধ্বংস হয়ে গেছে। সেসব থানা মেরামত ও যানবাহন সরবরাহ করতে হবে। যেসব এলাকায় পুলিশের তৎপরতা ছিল না, সেখানে কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‹নতুন এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি ও কমিশনাররা তাদের কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন, এখন কাজে গতি বাড়বে।
আ’লীগের পতনের পর শুধু ঢাকাতেই ৯৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ২৭৮টি মামলা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শকও রয়েছেন। এছাড়া ৮ জন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, ৭ জন উপমহাপরিদর্শক, ১২ জন পুলিশ সুপার, ১৪ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ছয়জন সহকারী পুলিশ সুপারও রয়েছেন।
সব থেকে বেশি মামলা হয়েছে, ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে। গতকাল পর্যন্ত ৩৮টি, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ৩৬টি, ক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৩টি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এছাড়া, সারা দেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা দায়ের হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে ৯ জন অতিরিক্ত আইজিসহ ১৭ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে। সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত দুই সপ্তাহে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ৩০০ ক্যাডার কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক কাজী জিয়া উদ্দিন বলেন, ইতিমধ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেছেন। সুত্র: ইনকিলাব