শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর আন্তরিকতার বদৌলতে  লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছার জমিদার বাড়ি  “জাদুঘর” হিসেবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে শীঘ্রই

স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর আন্তরিকতার বদৌলতে লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছার জমিদার বাড়ি “জাদুঘর” হিসেবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে শীঘ্রই

শহীদুল্লাহ ভূঁইয়াঃ বাংলার বিদূষী নারী লাকসামের নওয়াব (নবাব) ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়িটি অবশেষে জাদুঘর হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। আশা করা যাচ্ছে যে, দেশের স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের সুযোগ্য মন্ত্রী কুমিল্লা জেলার কৃতি সন্তান মোঃ তাজুল ইসলাম এমপি’র আন্তরিক সহযোগীতার ব-দৌলতে লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছার জমিদার বাড়ি অবশেষে একটি “জাদুঘর” হিসেবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে অতি শীঘ্রই!

            সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস পরিবেশিত ইত্তেফাক পত্রিকায় এ সম্পর্কে সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে যে, আগামী নভেম্বর মাসেই চালু হতে যাচ্ছে লাকসামের পশ্চিমগাঁয়ে অবস্থিত নওয়াব ফয়জুন্নেছা জমিদারবাড়ি দেশের একটি জাদুঘর হিসেবে। এ উপলক্ষে নবরূপে সেজে উঠছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী জাগরনের অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়িসহ পুরো নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারী কলেজ প্রাঙ্গন ও পশ্চিমগাঁও এলাকা। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাদুঘর’ উদ্বোধনের জন্য চলছে বিভিন্ন রকমের ব্যাপক আয়োজন।

            উলে­খ্য, ২০১৭ সালে গেজেট ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর লাকসাম উপজেলার উপকণ্ঠে অবস্থিত পশ্চিমগাঁও নওয়াব বাড়িসংলগ্ন ৪ দশমিক ৫৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে বিগত কয়েক বছরেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি। বরং ভূমিদস্যু ও অসাধু মহলের কারসাজিতে নওয়াব বাড়ির অনেক মূল্যবান ঐতিহ্য ও স্থাপনা কেবল ধ্বংস ও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবার তৎপরতাই অব্যাহত থাকে।

            অত:পর, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের হস্তক্ষেপে এহেন জটিলতার নিরসন হয়। এর পর পুনরায় শুরু করা হয় সব উন্নয়ন কর্মকান্ড। এতে করে মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের আহŸানে সাড়া দিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ চলতি বছরের ২রা জুন পশ্চিমগাঁয়ে অবস্থিত নওয়াব বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং এটিকে জাদুঘর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা প্রদান করেন।

অত:পর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদের উপস্থিতিতে গত ২০শে সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের মধ্যে পশ্চিমগাঁও নওয়াব বাড়িতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ এর উপস্থিতিতে (গড়ট) সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) চন্দন কুমার দে।

            এতে করে গত ৭ই অক্টোবর জাতীয় জাদুঘরের কনফারেন্স রুমে নওয়াব ফয়জুন্নেছার বংশধরদের সঙ্গেও এ ব্যাপারে এক মতবিনিময় ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাদুঘরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত মতবিনিময় ও আলোচনা সভায় নওয়াব ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল­ী সৈয়দ মাসুদুল হক, সৈয়দ কামরুল হক, এস এম মাহফুজুল হক, ওসমান আলী চৌধুরী, আয়াজ আলী চৌধুরী, কাজী মোহাম্মদ হোসেন শিপু, কাজী ইকবাল হোসেন খালেদ, সৈয়দা রেহানা হক, সৈয়দ গাজীউল হক, আইনুন নিশাত তাজোয়ার, সৈয়দ নাসির উদ্দিন হায়দার, সৈয়দ এনামুল হক, মনজুর আলম চৌধুরী ছোটন, সৈয়দ তানজিলা হক তান্নি, সৈয়দ তাওয়াজ আহমেদ, সৈয়দ আসফাকুল হক, সৈয়দ রাকিবুল হক, মাহমুদা হায়দার, আমীর সেলিম, সৈয়দ আজাদুল হক, কাজী সাজ্জাদ হোসেন, সৈয়দ কামরুন্নেছা হক, সৈয়দ তানজিনা হক, সৈয়দ সামসিয়া হকসহ নওয়াব ফয়জুন্নেছার ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম জেনারেশনের ২৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট লেখক গবেষক ড. এস এম ইলিয়াছ, বিশিষ্ট সাংবাদিক এম এস দোহা এবং জাতীয় জাদুঘরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।

            উক্ত সভায় উপস্থিত সকলে উন্মুক্ত মতামত ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করে সর্বসম্মতিক্রমে জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সম্মতি প্রকাশ করেন এবং সকল রকম সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। এ সময় জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, নওয়াব ফয়জুন্নেছার ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য ও সামগ্রী, যা এখন ইতিহাস। এসব নিদর্শন তার আত্মীয়স্বজন, পশ্চিমগাঁও ও আশপাশের এলাকার অনেকের কাছেই সংরক্ষিত আছে। এ সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ব্যবহৃত সামগ্রীসমূহ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়ার জন্য তিনি সবার প্রতি উন্মুক্ত আহŸান জানান।

লাকসামবাসীর জন্য অনেক দেরিতে হলেও সত্যিকারভাবে এটি এক ঐতিহাসিক ও আনন্দের সংবাদ হিসেবে উল্লেখ করে এলাকার অনেকে এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লাকসাম-মনোহরগঞ্জ আসনের সুযোগ্য সংসদ সদস্য- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনসহ প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছেন।

            লাকসামে এই মহৎ উদ্যোগ সংক্রান্তে গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নওয়াব ফয়জুন্নেছার এই জমিদার বাড়িতে জাদুঘরের শাখা স্থাপনের অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম -এর সাথে এক আলোচনা ও মতবিনিয় সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) চন্দন কুমার দে, নওয়াব ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল­ী সৈয়দ মাসুদুল হক, সৈয়দ কামরুল হক ও সাংবাদিক এম এস দোহা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

            প্রকাশ থাকে যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ১৮৩৪ সালে বাঙালি মুসলমানদের এক ক্রান্তিলগ্নে পূর্ব বাংলার কুমিল্লা জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলায় এই নারী শিক্ষার একজন অগ্রদূত, একজন জনহিতৈষী ও সমাজসেবী, ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর আবির্ভাব ঘটেছিল।

            বলা বাহুল্য, কুমিল্লা একসময় বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন খান ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অংশ সুবাহ বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ত্রিপুরা দখল করে। ১৭৬৯ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী একজন তত্ত¡াবধায়ক নিয়োগ করে। তখন ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লাকে ১৭৭৬ সালে কালেক্টরের অধীনস্থ করা হয়। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা।

  ওদিকে, তৎকালে বাঙালি মুসলমানরা ব্রিটিশদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আবার ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়ায় তারা শিক্ষাথী থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে উনিশ শতকে বাংলায় হিন্দু সমাজে যে জাগরণ শুরু হয়- তার স্পর্শ মুসলমানদেরকে আন্দোলিত করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এ শতকের শেষ দিকে এসে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। আর এসময় ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী কুমিল্লা জেলায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রচন্ড সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি শুধু মেয়েদের জন্যই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেননি, ছেলেদের জন্যও বিদ্যালয়, মাদরাসা ও মসজিদ স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি সমাজসেবা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও তৎকালে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা তথা লেখনী তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নারী সমাজের জাগরণে ও বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মেয়েদেরকে মুক্ত করে আলোর পথ প্রদর্শনে এক অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করে।

            কালক্রমে, ফয়জুন্নেসার শিক্ষাগত ও সাহিত্যিক কাজ ১৮৫৭ সালের পরবর্তী যুগের ছিল- যখন ভারতে মুসলমানরা ঔপনিবেশিক ক্ষোভের পূর্ণ প্রবণতা পেতে শুরু করেছিল এবং বঞ্চনা ও বৈষম্যের সীমায় ছিল। সেই সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ফয়জুন্নেসা মহিলাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিলেন। রূপকভাবে, তিনি রূপজালাল-এ একজন মুসলিম নায়ককে চিত্রিত করে হতাশা ও নৈরাশ্যবাদ থেকে সম্প্রদায়কে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন এবং এইভাবেই তাদের আশা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন।

            বলাই বাহুল্য নবাব ফয়জুন্নেসাই প্রথম বাংলায় মুসলিম নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা জেলার লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আহমদ আলি চৌধুরী। তিনি হোমনাবাদের জমিদার ছিলেন। মাতার নাম ছিল আরফানুন্নেসা। ফয়জুন্নেসার মাতামহও (নানা) একজন জমিদার ছিলেন। ফয়জুন্নেসা মাত্র দশবছর বয়সে পিতৃহীন হন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ফয়জুন্নেসার সাথে জমিদার মোহাম্মদ গাজি চৌধুরীর বিবাহ হয়। তবে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তাঁর দাম্পত্য জীবনটা তেমন সুখের হয়নি। এরপর, আরশাদুন্নেছা এবং বদরুন্নেছা নামে দু’টি কন্যার জন্মের পর তিনি বিচ্ছেদ হয়েছিলেন। ১৮৮৩ সালে তার মায়ের মৃত্যুুর পর তিনি জমিদার হন এবং সামাজিক ও দাতব্য কাজে ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িত হন এবং এইভাবে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা নবাব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তৎকালীন বাংলায় জমিদার হিসেবে আরো কয়েকজন নারী দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু নবাব উপাধি পাওয়া একমাত্র জমিদার ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।

            কুমিল্লা জেলার লাকসাম, বরুড়া, মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম, সদর দক্ষিণ, মুরাদনগর, চান্দিনা, তিতাস, হোমনা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফয়জুন্নেসার জমিদার বাড়ি। কোথাও বাড়িগুলো ভেঙ্গে পড়ছে, ভবনের উপরে গজিয়েছে বট গাছ। কোথাও কোথাও জমিদার বাড়ির অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে।

            বলা বাহুল্য, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে বাংলা স্বাধীনতা হারায়। পরবর্তীতে ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিওয়ানি লাভের পর থেকে বাংলার মুসলমানদের জীবনে চরম বিপযর্য় নেমে আসে। অর্থনৈতিকভাবে মুসলমানরা সর্বস্বান্ত হওয়ার পাশাপাশি ব্রিটিশ প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে অনীহা থাকায় তারা শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। অথচ, হিন্দু সম্প্রদায় এসময় ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষাদীক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে যায়। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হয় উনিশ শতকের শেষে এসে। বাংলায় হিন্দু সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণে মুসলমানরা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের অধঃপতন সম্পর্কে সচেতন হওয়া শুরু করে। এ সময় মুসলমানরা শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮)। তিনি সর্বপ্রথম ভারতীয় মুসলমানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে শমীউল্লাহ হাইস্কুলে এ্যাংলো  ওরিয়েন্টাল কলেজ শুরু করেন। পরবর্তীতে নবাব আব্দুল লতিফ (১৮২৬-১৮৯৩), সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৯) প্রমুখ ব্যক্তিত্ব শিক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা মুসলমানদের শতবর্ষ পূর্বের চিন্তাধারা, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। এ সকল মনীষীদের সমপর্যায়ের তৎকালীন নারীশিক্ষা বিস্তার ও নারীজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন এই নওয়াব (নবাব) ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী।

            তৎকালে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় মেয়েদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে ইউরোপ থেকে আগত খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিরা। তারা ১৮ শতকের শেষভাগে এদেশে বসবাসরত বেঙ্গল আর্মি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মৃত কর্মকর্তা ও কর্মচারির সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য ১৭৮২ সালে খিদিরপুরে আপার অরফ্যান স্কুল ও আলিপুরে লোয়ার অরফ্যান স্কুল নামে দু’টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিম্ন পরিবারের কিছু বাঙালি মেয়েরা শিক্ষা লাভ করে। ১৮৮৭ সালে একজন সুইডিস মিশনারি কলকাতায় মেয়েদের জন্য প্রথম একটি স্কুলের বালিকা শাখা খোলেন। এরপর থেকে ক্রমাগত  কলকাতা এবং আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় মিশনারিরা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে থাকেন এবং সেগুলোতে বাঙালি মেয়েরা পড়াশুনা শুরু করে। তবে এসব স্কুলের কারিকুলাম খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কিত হওয়ায় মুসলিম পরিবারগুলো তাদের মেয়েদেরকে এ সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণে প্রেরণ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে থাকতেন। অবশ্য, উনিশ শতকে বাংলায় মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে শ্রীরামপুর মিশনের অবদানটাই ছিল লক্ষণীয়। ১৮২৪ সালের মধ্যে তারা শ্রীরামপুরে ১৩টি, বীরভুমে ৭টি, ঢাকায় ৫টি এবং চট্টগ্রামে ৩টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

            অত:পর, ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ মিস মেরী অ্যান কুক-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮২৭ সালে ‘নারী সংঘ’ নামক একটি মিশনারি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়- যেখানে ১৬০ জন বালিকা পড়াশুনা করে এবং এদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান।

            এ প্রসঙ্গে ১৮২৮ সালে মিশনারি ইনটেলিজেনস পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, পূর্ব বাংলার যশোর জেলা জজ এইচ. এম লিগুর স্ত্রী মিসেস লিগু নিজের টাকায় যশোরে মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে প্রতিদিন দু’ঘন্টা করে তিনি মেয়েদের সেলাই শেখাতেন।

            এতে করে, শ্রীরামপুর মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম মেয়েরা পড়তো বলে সহজেই অনুমান করা যায়। তবে এসব বিদ্যালয় অর্থের অভাবে ১৮৩৮ সালের মধ্যে অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৬০ সালে পূর্ব বাংলায় ময়মনসিংহে আলেকজান্ডার ডাফ গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্ত প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তিতে বিদ্যাময়ী নামে পরিচিত হয়- যা আজও বতর্মান রয়েছে। আবার ১৮৬৩ সালের ১১ই মে ১৬ জন ছাত্রী নিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরে প্রথম সরকারি নর্মাল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এখানে মুসলিম ছাত্রীদের পড়ার সুযোগ ছিল না। স্কুলটি ১৮৭২ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৭ জন মেয়ে এখান থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।

            এহেন পরিস্থিতিকালে বলতে গেলে গোটা পূর্ববাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর ভূমিকাই হয়ে উঠেছিল অবিস্মরণীয়। ১৮৬৩ সালে পাবনায় বামা সুন্দরী একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তিনি নিজে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এখানে হিন্দু-মুসলিম মেয়েরা পড়তো বলে জানা যায়। অন্যদিকে, ১৮৬৩ সালে ঢাকায় ৩টি বালিকা বিদ্যালয় ও একটি যুবতি বিদ্যালয় ছিল। যুবতি বিদ্যালয়টি পরবর্তিতে বাংলাবাজার গার্লস স্কুল নামে পরিচিত হয়।

            উল্লে­খ্য, পূর্ব বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্রাহ্ম সমাজের অবদানই ছিল অতুলনীয়। ১৮৭৩ সালে ব্রাম্ম সমাজের মেয়েদের পড়াশুনার জন্য শুভসাধিনী সভার পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মিস মেরি কার্পেন্টার এই বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে এসে ঢাকায় অনুরূপ আরো একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করায় তদানুযায়ী ব্রাম্ম সমাজের কর্মীরা ঢাকায় আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অল্পসময়ের মধ্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টি একত্রিত হয়ে ঢাকা ফিমেল স্কুল বা ইডেন ফিমেল স্কুল নামে অভিহিত হয়।

            মূলত: গোটা পূর্ব বাংলার মুসলিম নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থেকেছিলেন কুমিল্লা জেলার পশ্চিমগাঁও-এর জমিদার নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী। তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও। কঠোর পর্দাপ্রথার বেড়াজালে অবস্থান করেও ফয়জুন্নেছা উপলব্ধি করেন নারীর জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যতিত দেশবাসীর সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। কুমিল্লা শহরে মেয়েদের জন্য তিনি পৃথকভাবে দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। একটি কুমিল্লার নানুয়াদিঘির পশ্চিমপাড়ে। পরবর্তীকালে এই বিদ্যালয়টি অন্য একজন নারীর নামে শৈলরাণী বালিকা বিদ্যালয় নামকরণ হয়েছে এবং ১৮৭৩ সালে কান্দিরপাড়ে আরেকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়টির সাথে ছাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থা করা হয় এবং ছাত্রীদের মাসিক বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়।

            অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, নবাব ফয়জুন্নেছা বোরকা পরে পালকিতে চড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদেরকে তাঁর বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য অভিভাবকবৃন্দকে অনুরোধ করতেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়টি ভারত উপমহাদেশে মুসলিম নারী শিক্ষার জন্য স্থাপিত প্রথম সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই পূর্ব বাংলার মুসলিম মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে  বিদ্যালয়টি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। ১৮৮০-৮১ সালের সরকারি শিক্ষা প্রতিবেদনে বিদ্যালয়টি “ঞযব নবংঃ মরৎষং ঝপযড়ড়ষ” (ইডেন ফিমেল স্কুল ব্যতীত) বলে প্রশংসনীয় হয়।

            ১৮৮৯ সালে তিনি স্কুলটিকে জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়  (অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) উন্নীত করেন। প্রথম দিকে এখানে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয় এবং নওয়াব ফয়জুন্নেছার মৃত্যুর অনেক পরে আনুমানিক ১৯৩১ সালের দিকে বিদ্যালয়টিতে ইংরেজি মাধ্যমে ছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান শুরু করা এবং প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

            আরো উল্লেখ্য যে, মুসলিম মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে প্রথমাবস্থায় কোনো মুসলিম মেয়ে পড়তো কিনা- তার সঠিক সন্ধান পাওয়া যায় না। এতে করে বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত হিন্দু ও ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরা অধিক পরিমাণে এখানে পড়াশুনা করতো। তবে সরকারি এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ১৮৭৭-৭৮ সালে ত্রিপুরা জেলায় ৬ জন ছাত্রী প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তাদের মধ্যে একজন ছিল মুসলমান কৃষক পরিবারের সন্তান। আর এতে করে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার মধ্যে কুমিল্লাতেই মুসলিম নারী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। তাই ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রীর উপস্থিতি অস্বাভাবিক ছিল না। অন্যদিকে, ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টির নামকরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিষ্ঠানটি ‘ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে কুমিল্লার বুকে বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে এটি সরকারিকরণের মাধ্যমে নামকরণ হয় “ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।”

            তবে পরবর্তীকালে ‘নবাব ফয়জুন্নেছা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট’ (১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত) এবং বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে প্রতিষ্ঠানটির নামের সাথে ‘নবাব’ শব্দটি সংযুক্ত হয়ে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।’ অবশ্য, তৎকালীন সমাজের নিম্নস্তরের বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন, যা উনিশ শতকে পূর্ব বাংলায় মুসলিম নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমে ফয়জুন্নেছার এক অনন্য কীর্তি। বতর্মান সময়েও বিদ্যালয়টি কুমিল্লায় নারীশিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছেন।

            এছাড়া, মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী তাঁর জমিদারির বেশ কয়েকটি মৌজা যেমন- ভাউকসার, ভাটরা, ছাতার পাইয়া, মানিকমুড়া এবং বাংগড্ডায় ছেলেদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। পশ্চিমগাঁওয়ে নবাব ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা হাইস্কুল নামে (ঘ.ঋ ্ ই.ঘ ঐরময ঝপযড়ড়ষ)- যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে- সেখানেও নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর অনেক অবদান রয়েছে।

            প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর পারিবারিক একটি ‘টোল’ (ছোট পরিসরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ছিল- যা পরবর্তীতে অনাকাংখিতভাবে আগুনে পুড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শিক্ষাব্রতী ফয়জুন্নেছার পক্ষে উক্ত টোলটির ধ্বংস মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। তিনি টোলটি টিকিয়ে রাখার জন্য তখন কন্যা বদরুন্নেছাকে অনুরোধ জানান। মাতার উৎসাহে বদরুন্নেছা ৯৫ ডেসিমেল জমি দান করে পুরাতন টোলটি নতুনভাবে সংস্কার করে এটিকে মাধ্যমিক ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত করেন। পরবর্তীকালে ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীনে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয় এবং প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে ‘বদরুন্নেছা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি আজও পশ্চিমগাঁওয়ে বিদ্যমান থেকে সুনামের সাথে হাজার হাজার স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলো দান করে যাচ্ছেন। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কামাল হোসেন হেলাল এবং পরিচালনা কমিটির প্রধান রয়েছেন, এডভোকেট রফিকুল ইসলাম হিরা।

            এছাড়া, তৎকালে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাদানের জন্য একটি অবৈতনিক মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেই মাদরাসাটি পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতেন। এই মাদরাসায় তৎকালীন ব্যয়ের হিসাবের সংক্ষিপ্ত তালিকা ছিলো: মাদরাসার মৌলভী: মাসিক বেতন ১২ টাকা হারে- বাৎসরিক ১৪৪ টাকা, কোরআন শরীফ পাঠ ও দুরুদ শরীফ দিনে হাজার বার পড়নকারি মোল্ল­া: মাসিক ৬ টাকা হারে- বাৎসরিক ৭২ টাকা এবং তালেব এলেমগণের লেখাপড়া করার জন্য রাত্রিকালীন আলো জ্বালানোর তেল বাবদ মাসিক ১২ আনা হারে বাৎসরিক ৯ টাকা। মাদরাসার বাৎসরিক সর্বমোট ব্যয় নির্বাহ করা হতো- সর্ব সাকুল্যে- ২২৫ টাকা। (সুত্র: নবাব শ্রীমতি ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী: ওয়াকফানামা, পৃ. ১২)।

            আরো প্রকাশ থাকে যে, এই মাদরাসাটি পরবর্তীকালে (১৯৪৩ সালে) নওয়াব ফয়জুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে, একইসাথে পুরাতন মাদরাসাটি সে সময়ে গাজীমুড়া গ্রামে স্থানান্তরিত হয় এবং সেটির নামকরণ করা হয় গাজীমুড়া (আলিয়া) মাদরাসা। অদ্যাবধিও উক্ত মাদরাসাটি অত্যন্ত সুনামের সাথে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন। অন্যদিকে, নওয়াব ফয়জুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজটি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে থাকছেন। এটি ১৯৬৫ সালে পূর্নাঙ্গরূপে ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরিত হয়। এই কলেজটিও নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজ নামে পরিচিত। অত:পর, বর্তমানে এটি একটি নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ। এখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় শ্রেণীকক্ষ, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার এবং সাধারণ কক্ষ রয়েছে। কলেজটি রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকেও মুক্ত। অত্র নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ-এর বর্তমান অধ্যক্ষ হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে নিয়োজিত রয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করছেন- প্রফেসর মেজর মিতা সাফিনাজ (চৎড়ভবংংড়ৎ গধলড়ৎ গরঃধ ঝধভরহধু, চৎরহপরঢ়ধষ)। ফলশ্রæতিতে কলেজটি উপজেলার অন্যতম কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে তারিখে কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়।

            এছাড়া, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই কলেজে স্নাতক (সম্মান) বিভাগ চালু হয়েছে। তবে, এখনো অবকাঠামোগত পুরোপুরিভাবে তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হয়নি। বর্তমানে কলেজটিতে কমপক্ষে সাতটি বিষয়ে অনার্স (সম্মান) কোর্স চালু রয়েছে। কলেজে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার জন।

            সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে সম্মান বিভাগ চালু হওয়ার কারণে কলেজটিতে প্রদর্শকের পদসহ সর্বমোট ৭৯ জন শিক্ষকের পদ তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও তা আজ পর্যন্তও পূর্ণ হয়নি। ফলে অনেকটা সেই পুরনো মঞ্জুরিকৃত শিক্ষকের পদই বহাল রয়েছে।

            এছাড়া, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী পশ্চিমগাঁওয়ে নিজ বাসভবনের পাশে দশ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদও স্থাপন করেছিলেন তৎকালে। এখানে হর-হামেশা দীন-ইসলামের আলোচনা চলতো এবং স্থানীয় লোকজনদের কোরআন শিক্ষা দেয়া হতো।

            অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে নির্মিত সেই মসজিদটি বর্তমানে নওয়াব বাড়ির চত্বরে দারুন জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এছাড়াও এই মুসলিম মহীয়সী নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী মেয়েদের চিকিৎসার জন্য কুমিল্লায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি দূর-দূরান্ত থেকে দেশ-বিদেশে যাতায়াতের সময় পরিশ্রান্ত এবং অভাবগ্রস্ত  ব্যক্তিদের সেবার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়িতে বিরাট একটি মুসাফিরখানা স্থাপন করেন। যে কোনো মুসাফির সেখানে নির্ভাবনায় আশ্রয় নিতে পারতেন। এমনকি ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী পবিত্র মক্কায় হজ্জ্ব পালন করতে গিয়েও নিজ অর্থ ব্যয়ে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নহরে জোবায়দা খালটি পুনঃখনন করিয়েছিলেন।

            উনিশ শতকে মুসলিম নারী সাহিত্যিক হিসেবেও ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৮৭৬ সালের ১০ই ফেব্রæয়ারি ঢাকা গিরিশ মুদ্রনযন্ত্র থেকে ফয়জুন্নেছা রচিত আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যগ্রন্থ ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে ফয়জুন্নেছা বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম নারী গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। এ কাব্যগ্রন্থে তিনি নারীর রূপের বর্ণনার পাশাপাশি মেয়েদের সামাজিক মর্যাদারও পূর্ণ প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশা  করেছেন। ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী ‘সংগীত সার’ ও ‘সংগীত লহরী’ নামে আরো দু’খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রন্থ দু’টির কোনো মুদ্রিত কপি বা অখন্ড পান্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া দুস্কর!

            প্রসঙ্গক্রমে, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পূর্ব বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ফয়জুন্নেছার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোর পরই ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮৩ সালের ২৪শে ফেব্রæয়ারি ঢাকা কলেজের কতিপয় ছাত্রের উদ্যাগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই সংগঠনটি মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারকে মূল কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে সফলতা অর্জন করেছেন। পর্দাপ্রথার কঠোরতার কারণে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষাদান অসম্ভব ভেবে এই সম্মিলনী গৃহশিক্ষাকে অবলম্বন করে ছাত্রীদেরকে গৃহশিক্ষক দ্বারা গৃহপরিমন্ডলে পড়ানো এবং বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, সম্মিলনী প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় ৩৪ জন পরীক্ষার্থী সফলতা লাভ করেন এবং তারা সকলেই ছিলেন মুসলিম পরিবারের কন্যা সন্তান।

            এভাবে পূর্ব বাংলায় মুসলিম মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বালিকা বিদ্যালয়ের পরই ছিল ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনীর অবস্থান।

            অন্যদিকে, ১৮৯৭ সালের ১৯শে জানুয়ারী কলকাতায় মুসলিম মেয়েদের জন্য মুসলিম বালিকা মাদরাসা স্থাপিত হয়। মুর্শিদাবাদের জমিদার নওয়াব শামসি জাহান ফেরদাউস মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ২৫ জন ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়।

            ১৯০৩ সালের একটি জরিপে দেখা যায় যে, তখন সমগ্র বাংলায় ১,০০,৩২২ জন বালিকা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে; তার মধ্যে মাত্র ১% ছাত্রী ছিল মুসলমান। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত সর্বমোট ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮১৬ জন। এর মধ্যে ৪৩৯ জন হিন্দু, ৫ জন মুসলমান, ২৮৬ জন দেশীয় খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল ৮৯ জন।

            ১৮৮১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত বামাবোধিনী পত্রিকায় শুধু কলকাতার নারীশিক্ষার একটি পরিংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৮৮১, ১৮৯১ ও ১৯০১ সালে হিন্দু ছিলো যথাক্রমে- ৬% ৭% ৯%, মসুলিম ১% ১% ৩% এবং খ্রিস্টান, ব্রাম্ম ও বৌদ্ধ ছিল যথাক্রমে- ৭% ৭% ৭% ৬৪% ৬৫% ৫৩% ১২% ২৫% ১৫%। সূত্র: বামাবোধিনী পত্রিকা, ৪৭৭ সংখ্যা, [মে-জুন, ১৯০৩, পৃ. ৮]।

            উপরোক্ত  আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শুধু পূর্ব বাংলা নয়; বরং কলকাতা থেকে শুরু করে সমগ্র বাংলায় উনিশ শতকে মুসলিম নারীশিক্ষার হার ছিল অত্যন্ত নগন্য। বিশ শতকের শুরু থেকে এই অবস্থার দ্রæত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯১১ সালে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮৮-১৯৩২) মুসলিম সমাজের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে কলকাতায় ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে মেয়েরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করে। ফলে বিশ শতকের প্রারম্ভ হতে পরবর্তী সময়ে বাংলায় মুসলিম নারীশিক্ষা বিস্তারে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বালিকা বিদ্যালয়টিও মাইলফলক হিসেবে কাজ করে চলেছে।

            সত্যিকার অর্থেই নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী কর্তৃক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করণটা পূর্ব বাংলার শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মূলত: উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-বিশেষ করে মুসলিম নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। তৎকালীন সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মেয়েদের জন্য কঠোর পর্দাপ্রথা ও অবরোধপ্রথা প্রচলিত থাকায় বাঙালি নারী সার্বিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। ঠিক এমন একটি সময়ে ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে অমর ইতিহাস কায়েম করেন।

            উল্লেখ্য, ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একই বছরে ঢাকায় ইডেন ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ইডেন ফিমেল স্কুলটি ব্রাম্ম সমাজের পুরুষ প্রতিনিধিরা প্রতিষ্ঠা করেন। এক্ষেত্রে কুমিল্লার মত প্রত্যন্ত জনপদে একজন নারী কর্তৃক নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ছিল একটি দুঃসাহসিক কার্যক্রমই বটে। ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়টি পূর্ব বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে তা অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে হিন্দু মেয়েরা এখানে বিদ্যার্জন করলেও অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে অনেক মহীয়সী নারীর জন্ম হয়, যারা পূর্ব বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে এবং নারী জাগরণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। এ প্রতিষ্ঠানটি আজও ‘নবাব ফয়জুন্নেছা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে কুমিল্লায় নারীশিক্ষা প্রসারে নিরলসভাবে জ্ঞানের আলো বিতরণে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

            বাস্তবিক পক্ষেই, উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজ ছিল রাজনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত, অর্থনৈতিকভাবে পর্যদুস্ত, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং নানাবিধ কুসংস্করাচ্ছন্ন এক সমাজ। পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কঠোর অবরোধপ্রথা ও পর্দাপ্রথার বেড়াজালে নারীর অবস্থা ছিল আরো করুণ। অন্যদিকে, উনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানদের পূনর্জাগরণে যে সকল নেতার আবির্ভাব হয়- তারা পুরুষ সমাজের অবস্থার পরিবর্তনেই বেশি তৎপর ছিলেন! নারী সম্পর্কে তাদের ভাবনা ছিল অতি নগন্য। এরূপ পরিস্থিতিতে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর আবির্ভাব ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলিম নারীসমাজের জন্য নি:সন্দেহে এক আর্শীবাদ স্বরূপ। ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যা উপেক্ষা করে তিনি মুসলিম নারীকে শিক্ষিত করে তোলার জন্যই এত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বিরাট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সত্যিকারভাবেই তৎকালে অত্র এলাকায় নারীশিক্ষা বিস্তারে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখিছিল তিনি। অন্যদিক, তাঁর কাব্য প্রতিভা তৎকালীন পুরুষ সাহিত্যিকদের সক্ষমতা অর্জনে এবং পূর্ব বাংলায় নারী জাগরণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

            এছাড়া, তিনি নানামুখী জনকল্যাণ মুলক অসংখ্য কাজ করেন। তৎকালীন সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নারীশিক্ষা কার্যক্রম ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে তিনি বিরাট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মূলত: তাঁর এ সকল অসংখ্য-অগণিত অবদানের জন্যই ব্রিটিশ মহারাণী ভিক্টোরিয়া কতৃর্ক বাংলার এই মহীয়সী নারী “নবাব” খেতাব প্রাপ্ত হন। আর তিনিই বাংলার প্রথম এবং শেষ “নারী নবাব” ছিলেন।

            অবশেষে একান্ত সত্যিকারভাবে এটা বলা যায় যে, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী সমাজ ও নারী উন্নয়নের এক খ্যাতিমান কান্ডারী ছিলেন। এই উপমহাদেশের একমাত্র খেতাব প্রাপ্ত প্রথম নারী যিনি- নবাব উপাধি অর্জন করেছিলেন নিজ যোগ্যতার বলেই। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বৎসর ন্যায়পরায়নভাবে জমিদারী শাসন করেছিলেন। নবাব ফয়জুন্নেছা বাংলার প্রথম মুসলিম মহিলা কবি ছিলেন বটে; যার কাব্যগ্রন্থ ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৬ সালে। তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণ। তিনি সূদীর্ঘ কাল সমাজের কল্যাণে দুঃস্থ মানবতার জন্য সমাজের উন্নয়নমূলক কল্যাণমুখী নানান কাজ করে গেছেন। স্বল্প পরিসরে তার বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়।

            ফয়জুন্নেছার অনেক কর্মকান্ড ইতিহাসের কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে- তারপরও তার কিছু কর্মকান্ড এখনো উজ্জীবিতই। জাতির উন্নয়নের জন্য তার শিক্ষা বিস্তার প্রশংসনীয় এবং স্বাস্থ্য সেবায়ও অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি সমাজের নারী উন্নয়নের সর্বদা সচেতন ছিলেন। আমাদের দেশের নারী উন্নয়নের প্রথম অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছা। অথচ আমরা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতকে নারী মুক্তির অগ্রদূত বলে থাকি? এ কথা সঠিক নয় বলেও অনেকেই বলে থাকেন। কারণ বেগম রোকেয়ার জন্মেরও আগে ফয়জুন্নেছা নারীদের উন্নয়নের জন্য বহু পদক্ষেপ নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। আর রোকেয়ার জন্মের ৭ বৎসর পূর্বেই ১৮৭৩ খ্রীঃ নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফয়জুন্নেছার প্রতিষ্ঠিত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৪৬ বৎসর পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। অথচ আমরা ভুল ইতিহাস পড়ে আসছি। ফয়জুন্নেছাকে নারী মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা! যে নারী একটা অন্ধকার যুগে সাহসিকতার সঙ্গে সমাজের জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, অথচ আজ বর্তমান প্রজন্ম ফয়জুন্নেছা সম্পর্কে ততটা অবগত নন! ইতিহাসের পাতায় তাকে স্থান দিতে পারিনি। যেটা কিনা অনেক দুঃখকর?

            ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর জন্ম ১৮৩৪ খ্রিঃ কুমিল্লা জেলার অর্ন্তগত লাকসামের পশ্চিমগাঁওস্থ পৈত্রিক বাড়িতে। তার পিতার নাম জমিদার আহমদ আলী এবং মাতা ছিলেন নন্দিনী আরফান্নেছা। তাঁর দুই ভাই- ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী, ছোট বোন লতিফুন্নেছা চৌধুরানী। তিনি তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ফয়জুন্নেছার পড়াশোনার প্রতি অতি আগ্রহ দেখে তার বাবা উপযুক্ত গৃহ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনকার সময় নারীদের জন্য পুরুষ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিলনা। কিন্তু ফয়জুন্নেছা সামাজিক প্রতিকূলতার সুকঠোর নিয়মের বাইরে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন উস্তাদ তাজউদ্দিন এর কাছে। তিনি শিক্ষিত ছিলেন- আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত এবং বাংলাসহ কয়েকটি ভাষা লিখতে, পড়তে এবং বলতেও পারতেন। এছাড়াও তিনি নানা জনহিতকর কাজের জন্য ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছেন এবং থাকবেন কেয়ামত তক্। বাংলাদেশের সরকার ২০০৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেছিলেন। তাঁর নামে সরকারি ডাক টিকেট বের করা হয়।

            এছাড়া, বিরাট জনহিতৈষী কাজের জন্য ১৮৮৯ সালে ব্রটিশ সরকার মহারানি ভিক্টোরিয়া জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীকে “নবাব” উপাধিতে ভূষিত করেন, যার ফলে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নবাব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। অবশ্য, নবাব উপাধি পাওয়ার আগে ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে দুইবার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে ‘বেগম’ উপাধি দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ‘বেগম’ উপাধি ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অত:পর, ৩য় দফায় তাঁকে নবাব উপাধি প্রদান করা হয়। অবশেষে, ১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি কুমিল্লার লাকসামে মৃত্যুবরণ করেন। মহান করুণাময়ের নিকট আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

            ঈড়ঁৎঃবংু ্ জবভ: রওশন আরা বেগম, নবাব ফয়জুন্নেছা, মুসলিম সমাজ (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩), পৃ. ৯৭, সোনিয়া নিশাত আমিন, বাঙালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, অনুবাদ: পাপড়ীন নাহার (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০০২), পৃৃ. ১০৮, মালেকা বেগম ও সৈয়দ আজিজুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৩, এবং এ. এইচ. এম. মহিউদ্দিন, “নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মোতওয়াল­ী আলহাজ্ব ছৈয়দ ছেরাজুল হক”, স্ফুরণ, নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজ এবং কলেজ বার্ষিকী, নবজাগরণ, খবর অন্যান্য তথ্যসুত্র থেকে।

Share This